আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে আবারও অংশ নিতে যাচ্ছেন। আর এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন।
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছেন জো বাইডেন। কে এই কমলা হ্যারিস? কেনই বা তাকে বেছে নিলে জো বাইডেন? কমলা সম্পর্কে এমন অনেক তথ্যই হয়তো এখনও অজানা।
আজকের এই প্রতিবেদন কমলা হ্যারিসের জীবনের অজানা কিছু গল্প পাঠকের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা। কমলা হ্যারিস জানিয়েছেন, তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার হচ্ছে ফেভারিট ডিশের মধ্যে পড়ে ইডলি এবং সম্বর। শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের মেয়ে কমলা দেবী হ্যারিস সংক্ষেপে কমলা হ্যারিস কখনওই তার নিজের শিকড়কে ভোলেননি।
সত্যি বলতে ভুলতে তিনি কখনই সেটা চাননি। নিজের আত্মকথায় তিনি লিখেছেন, ‘শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের মেয়ে-এই পরিচয়টুকুর চেয়ে বড় কোনও সম্মান পৃথিবীতে হতে পারে বলে আমি বিশ্বাসই করি না।’
রূপকথার মতো জীবন তার। কমলা জানিয়েছেন, তার জীবনে তার মায়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে তিনি কখনও তার নানা-নানিকে ভুলতে পারবেন না। একটি সাক্ষাৎকারে একবার নিজেই জানিয়েছিলেন তার একেবারে ছোটবেলার প্রিয় কিছু স্মৃতির কথা।
মাদ্রাজে দু’বছর পর বাবা-মাকে দেখতে যেতেন কমলার মা শ্যামলা গোপালন। সঙ্গে থাকত তার দুই মেয়ে কমলা এবং মায়া। ছোট্ট কমলার মনে পড়ে কীভাবে প্রতিদিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রের তীরে হেঁটে বেড়াতেন তার নানা পিভি গোপালন। পিভি নিজে দেশের জন্য লড়েছেন, স্বাধীন দেশে প্রশাসনের খুবই উঁচু দায়িত্ব সামলেছেন এবং সারা জীবন ধরেই তার লড়াই ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
সেই মর্নিং ওয়াকের সময় বাচ্চা কমলা থাকত দাদুর পাশে আর চুপ করে শুনত কিভাবে নানা এবং তার সঙ্গীরা সুবিচার নিয়ে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে আর রাজনীতির নানা ওঠাপড়া নিয়ে কথা বলছেন। কমলা পরে বলেছেন, সেই সব মর্নিং ওয়াক থেকে জীবনে খুব দামি একটা শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। সততার জন্য লড়াই করার শিক্ষা। পাশাপাশি তার নানি রাজম গোপালনের ছায়াও কমলার স্বাধীনচেতা চরিত্রের মধ্যে স্পষ্ট।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া রাজম শুধু ঘরের মধ্যেই আটকে রাখেননি নিজেকে। যেসব মেয়ে অত্যাচারের শিকার তাদের জন্য বার বার প্রতিবাদ করেছেন তিনি। গত শতকের চল্লিশের দশকে রাজম নিজে ফোক্স ভাগেন গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন চতুর্দিক, গরিব মেয়েদের শেখাতেন জন্ম নিয়ন্ত্রণের নানা রকম সুবিধা। আত্মকথায় কমলা লিখছেন-‘আমার নানা তো ঠাট্টা করে বলতেন নানির এই অ্যাকটিভিজিমের ঠেলায় তার কেরিয়ারটাই না বরবাদ হয়ে যায়। নানি অবশ্য সে সব কথায় পাত্তাই দেননি কোনদিন।’
যুক্তরাষ্ট্রে যখন বেসামরিকদের অধিকারের আন্দোলনে উত্তাল, তখনই আস্তে আস্তে বড় হচ্ছেন কমলা। বাবা-মা সেই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে হাঁটতেন মিছিলে, জড়ো হতেন বিভিন্ন জমায়েতে। কমলা জানিয়েছেন, তার একেবারে ছোটবেলার ঝাপসা স্মৃতির মধ্যে আছে চারিদিকে অসংখ্য পা হেঁটে চলেছে সারিবদ্ধভাবে।
আর সেই মিছিল থেকে নানা রকম স্লোগান আসছে। মা শ্যামলা জানিয়েছিলেন, তার বড় মেয়ে অর্থাৎ কমলার মুখে যখন সবে বুলি ফুটেছে, তখন সে মাঝেমাঝেই কান্নাকাটি করত আর কী চাই জিজ্ঞাসা করলে ঠোঁট ফুলিয়ে আধো আধো গলায় বলত, ‘ফিদম’।
বাবা জ্যামাইকান মা ভারতীয়, ফলে জন্মসূত্রে নানা রকম সংস্কৃতির মধ্যে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছিলেন কমলা। ২০০৩ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার সব বন্ধুই ছিল ব্ল্যাক আর আমরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে নানা রকম ভারতীয় খাবার-দাবার রান্না করতাম। হাতে হেনাও করতাম খুব মজা করে।’
এমন মিশ্র সংস্কৃতির কারণে দুই বোন কমলা ও মায়া কখনও হয়তো ব্ল্যাক ব্যাপটিস্ট গির্জায় গিয়ে কয়্যারে গেছেন আবার ফিরে এসেই মার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা দিয়েছে হিন্দু কোনও মন্দিরের দিকে। এই নানামুখী সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার জন্যেই কমলার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও হয়েছিল। কখনও বাবার সঙ্গে জ্যামাইকা, কখনও মায়ের সঙ্গে ভারত।
এ ব্যাপারে একটি মজার গল্প বলেছিলেন একবার শ্যামলা গোপালন নিজেই। সানফ্রান্সিসকো ম্যাগাজিনকে তিনি জানিয়েছিলেন কমলা যখন মাত্র ফার্স্ট গ্রেডের শিক্ষার্থী তখন স্কুলেরই এক শিক্ষিকা শ্যামলাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘জানেন, আপনার মেয়ের কল্পনাশক্তি দারুণ। যখনই ক্লাসে দূরের কোনও না কোনও দেশের কথা হয়, তখন ও ঠিক মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ আমি তো ওখানে গিয়েছিলাম।’
তখন শ্যামলা সেই শিক্ষিকাকে জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন যে বাচ্চা মেয়েটি মনগড়া কিছু বলেনি, কারণ সত্যিই সে তত দিনে ভারত, ইংল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড, আফ্রিকা এমন নানা জায়গায় ঘুরে ফেলেছে।
কমলা হ্যারিস তখন সান ফ্র্যান্সিসকোর ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি পদের জন্য প্রচারণা শুরু করেছেন। সে সময় তিনি জানান, কোনও মামলাতেই আর মৃত্যুদণ্ড কখনও চাইবেন না। তিনি ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই মর্মান্তিক একটা কাণ্ড ঘটে গেল। কর্তব্যরত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলেন তরুণ পুলিশ অফিসার আইজাক এসপিনোজা।
হ্যারিস জানিয়ে দিলেন, কাণ্ডটি খুবই দুঃখজনক কিন্তু তিনি নিজের ঘোষিত নীতি থেকে সরবেন না। অর্থাৎ খুনিদের মৃত্যুদণ্ড চাইবেন না কিন্তু এমন যাবজ্জীবন কারাবাস চাইবেন যেখানে প্যারোলে বাইরে আসার কোনও সুযোগ থাকবে না। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল।
পুলিশ ইউনিয়ন এবং এসপিনোজার পরিবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু নামজাদা রাজনীতিবিদও চেঁচামেচি শুরু করলেন। এসপিনোজার শেষকৃত্যে জনৈক সিনেটর স্টান, যিনি এক সময় সান ফ্র্যান্সিসকোর মেয়র ছিলেন তিনি ঘোষণা দিলেন ‘এই ঘটনা মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি তো বটেই এবং এই জাতীয় ঘটনাই আরও বেশি করে দেখিয়ে দেয় মৃত্যুদণ্ডের আইনটা কেন এত জরুরি।’
চারদিক থেকেই চাপ ছিল প্রবল। কিন্তু কমলা হ্যারিস তার পথ থেকে সরেননি। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে এসপিনোজার খুনিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই হয়। কমলা যা চেয়েছিলেন সে রকমই অর্থাৎ যেখানে প্যারোলের কোনও সুযোগ থাকবে না।
২০১২ সালে ডেমোক্র্যাটদের ন্যাশনাল কনভেনশনে প্রাইম টাইম বক্তা ছিলেন কমলা হ্যারিস। সেই প্রথম পুরো দুনিয়া নড়েচড়ে বসে, জানতে চায় কে এই নারী। পরের বছর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কমলাকে ‘বুদ্ধিমতি’, ‘আত্মত্যাগী’ এবং ‘কঠোর’ বলার পাশাপাশি একটু লঘু চালে এমনই একটি কথা বলে বসেন যার জন্য পরে তাকে ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল। কমলা সম্পর্কে ওবামার সেই মন্তব্যটি ছিল, ‘এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে সুন্দরী অ্যাটর্নি জেনারেল তিনি’।
কমলা হ্যারিস জানিয়েছেন, তিনি প্রতিদিন সকালে ব্যায়াম করেন। ২০১৬ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনের রুটিনে দুটি জিনিস আমাকে রাখতেই হবে। এক, ব্যায়াম। দুই, ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া।’ প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়েও খুবই উৎসাহী কমলা।
নিজে রান্না করতে ভালোবাসেন। প্রায়ই সেসব রান্নাবান্নায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন স্বামী ডাগ এমহফ। যখন খুব চাপে থাকেন রান্না করার সময়টুকুও মেলে না, তখন রিল্যাক্স করার জন্য ঠিক কী করেন কমলা হ্যারিস? তার উত্তর বিভিন্ন রেসিপির বই পড়েন। তাতেই নাকি মনটা অনেকটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে তার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন