এক তরুণী মুঠোফোনে পুলিশের গতিবিধির সব খবর জানাচ্ছিলেন ভারতের কলকাতার আনন্দপুর কাণ্ডের অভিযুক্ত অভিষেক কুমার পান্ডেকে। আর ‘নির্যাতিত’ ওই তরুণীর কাছ থেকে আগাম খবর পেয়েই পূর্ব যাদবপুরের গেস্ট হাউস থেকে গত সোমবার বিকেলে পালিয়ে যান অভিষেক। ঘটনার দিন থেকে আগাগোড়া পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন ওই তরুণী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার রাতে অভিষেক গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোটা ঘটনা অনেকটাই স্পষ্ট হয় পুলিশের কাছে। নয়াবাদের বাসিন্দা ‘নির্যাতিতা’ তরুণী, অভিষেক, তার মা ও জামাইয়ের জবানবন্দি থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে অভিষেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ওই তরুণীর। তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউনের জন্য বিয়ে পিছিয়ে যায়।
গত শনিবার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, অন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মতো ওই রাতেও হবু স্ত্রীকে (নির্যাতিত তরুণী) নিয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফেরার পথে কোনো বিষয় নিয়ে দুজনের ঝগড়া শুরু হয়। তা নিয়ে গাড়ির মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি, মারামারি। ওই তরুণী অভিষেকের হাতে কামড় দেন, পাল্টা অভিষেকও হবু স্ত্রীয়ের মুখে ঘুসি মারেন। ওই অবস্থায় দুজনের ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, তরুণী গাড়ি থেকে নেমে যেতে চান।
অভিষেক ও তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, গাড়ির গতি খুব কম ছিল এবং গাড়িতে বসে চিৎকার করছিলেন তরুণী। সেই চিৎকার কানে যায় দীপ শতপথী এবং তার স্ত্রীর। ইতিমধ্যে অভিষেক গাড়ি থামিয়ে দিলে নামতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে যান তরুণী। আর পড়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে আটকে ছিড়ে যায় তার পোশাকের একটি অংশ। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে এসেছেন নীলাঞ্জনা। অন্যদিকে তরুণী তখনো রাগের মাথায় অভিষেককে গালিগালাজ করছেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পালানোর চেষ্টা করেন অভিষেক। পুলিশ সূত্রে খবর, অভিষেক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, পালাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা লাগে নীলাঞ্জনার সঙ্গে।
ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে সোজা নিজের বাড়ি যান অভিষেক। গাড়ি রেখে যান নির্যাতিত তরুণীর বাড়িতে। সেখানে তরুণীর ঘরের চাবি এবং মোবাইল ফোন দিয়ে আসেন। তারপর এক বন্ধুর বাড়ি চলে যান।
কেন মিথ্যা বললেন তরুণী?
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণী জানান, অভিষেক পালিয়ে যাওয়ার পর বিপদে পড়েন তরুণী। কারণ নীলাঞ্জনা গুরুতর জখম হন। তরুণী তাই সাহস করে বলতে পারেননি যে, অভিষেক তার পরিচিত। প্রথমে তিনি অভিযোগ দায়ের করতেও চাইছিলেন না। পরে পরিস্থিতি দেখে তিনি সত্য গোপন করে পুলিশকে জানান যে, অভিযুক্তের নাম অমিতাভ বসু এবং তার সঙ্গে মাত্র কয়েকদিন আগে তার আলাপ হয়েছে।
কীভাবে জানা গেল আসল পরিচয়?
কলকাতা পুলিশ জানায়, তরুণীর দেওয়া ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রথমে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল থানা। পরে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগ। ঘটনার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর রোববার বিকেলে তারা তরুণীর কল রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়েই আবিস্কার করেন অভিযুক্তের সঙ্গে নির্যাতিত তরুণীর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। এমনকি ঘটনার পরও তরুণী ফোন করেছিলেন অভিযুক্তকে। তখন জেরার মুখে তরুণী স্বীকার করেন যে, অভিযুক্ত তার হবু স্বামী এবং তার নাম অভিষেক কুমার পান্ডে।
অভিষেকের খোঁজ মিলল যেভাবে?
পুলিশের দাবি, রোববার অভিষেকের বাড়ির ঠিকানা পেয়ে পুলিশ গাড়ির খোঁজ পায়। কিন্তু ততক্ষণে তরুণীর কাছ থেকে পুলিশের গতিবিধির খবর পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। মোবাইল ফোনও বন্ধ। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা পূর্ব যাদবপুরে একটি গেস্ট হাউসে যায়। কিন্তু সেখানে সোমবার বিকেলে লকডাউনের দিন পুলিশ পৌঁছে দেখে অভিযুক্ত এক ঘণ্টা আগেই পালিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই গেস্ট হাউসের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে আাসা একটি ট্যাক্সি চেপে অভিষেক পালিয়েছেন।
তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ওই ট্যাক্সিচালকের খোঁজ পায়। তাকে জেরা করে মধ্য কলকাতায় এক আইনজীবীর সন্ধান মেলে। তার কাছে সোমবার সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন অভিষেক। কিন্তু ওই আইনজীবী অভিষেকের মামলা নিতে না চাওয়ায় সেখান থেকে ফের পালান তিনি। এরপর মোবাইলের সূত্র ধরেই অভিষেকের খোঁজ মেলে দমদম এলাকায়।
আজ বুধবার অভিষেককে আলিপুর আদালতে তোলা হবে। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘এটা সত্যি যে, কোভিড পরিস্থিতিতে থানার লোকবল খুব কম। তাও পুলিশ যদি শুরুতেই রুটিন তদন্ত করত তাহলে এই মামলা এত দূর পর্যন্ত গড়াত না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন