লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণের জেরে পদত্যাগ করেছে দেশটির সরকার। গত সপ্তাহের এসব ঘটনা যেন বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সীমাহীন দুর্নীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে। বৈরুত বন্দরের ওই বিস্ফোরণ শুধু বিপজ্জনক রাসায়নিকের কারণেই ঘটেনি, এর পেছনে ছিল লেবানিজ সরকারের দীর্ঘদিনের অদক্ষতা আর ব্যক্তিস্বার্থের ঝনঝনানি।
একনজরে দেখে নেয়া যাক লেবাননে গত সাতদিনের ভয়াল পরিক্রমা
৪ আগস্ট
ঘটনার শুরু বৈরুত বন্দরের একটি গোডাউনে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড দিয়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা শহর। বিস্ফোরণের ধাক্কা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ১৫০ মাইল দূর থেকেও অনুভূত হয় এর প্রভাব। এতে প্রাথমিকভাবে শতাধিক প্রাণহানি এবং চার হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
বিস্ফোরণে ধূলিসাৎ হয়ে যায় বৈরুত শহরের অর্ধেকটা। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে অন্তত তিন লাখ মানুষ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ’ কোটি ডলার।
৫ আগস্ট
লেবানিজ প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বৈরুতে দুই সপ্তাহের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। লেবাননের ইতিহাসে ভয়াবহতম দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবধরনের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে।
লেবাননের প্রেসিডেন্টসহ সব নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হাই ডিফেন্স কাউন্সিল বৈরুতকে বিপর্যস্ত শহর হিসেবে ঘোষণা দেয়।
বন্দরে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ২ হাজার ৭৫০ টন বিপজ্জনক অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত থাকার তথ্য প্রকাশ্যে আনেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী।
৬ আগস্ট
ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ বৈরুতে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করেন এবং মানবিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেন।
ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রতিবাদে লেবাননে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা এ দুর্ঘটনায় দায়ীদের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার দাবি জানান।
বিস্ফোরণের ঘটনায় দোষী অভিযোগে বন্দরের ১৬ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের কথা জানান লেবাননের সামরিক আদালতে সরকারের প্রতিনিধি বিচারক ফাদি আকিকি।
৭ আগস্ট
লেবানিজ কর্মকর্তাদের হিসাবে বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৭ জনে, আহত পাঁচ হাজারেরও বেশি।
২০১৩ সালে যে জাহাজের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জব্দ করা হয়েছিল সেটির সাবেক ক্যাপ্টেন বরিস প্রকোশেভ জানান, বৈরুত বন্দরের কর্মকর্তারা এ রাসায়নিক মজুত রাখার বিপদ সম্পর্কে ভালো করেই জানতেন।
লেবাননকে তাৎক্ষণিক সহায়তা হিসেবে ৩৩ মিলিয়ন ইউরো দেয়ার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
৮ আগস্ট
চলমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ উল্লেখ করে লেবাননে আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।
কাতায়েব পার্টি লেবানিজ সংসদ থেকে তাদের তিন সদস্যের পদত্যাগের ঘোষণা দেয়।
লেবানিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বৈরুতে বেশ কয়েকটি সরকারি দপ্তরে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। ক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে রাবার বুলেট-টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ।
সংঘর্ষে সাতশ’রও বেশি মানুষ আহত হন, প্রাণ হারান এক পুলিশ সদস্য।
৯ আগস্ট
ফ্রান্স ও জাতিসংঘের নেতৃত্বে ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দেন আন্তর্জাতিক নেতারা। সরাসরি লেবানিজ জনগণকে সহায়তা দিতে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তারা।
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকারের ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন লেবাননের তথ্যমন্ত্রী মানাল আবদেল সামাদ। দিনের শেষভাগে পদত্যাগ করেন দেশটির পরিবেশমন্ত্রী দামিয়ানোস কাত্তার।
১০ আগস্ট
অন্য দেশগুলোকে বৈরুত বিস্ফোরণ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় ইরান। লেবাননের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানায় তারা।
জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার প্রধান জানান, মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই লেবাননের খাবার ফুরিয়ে যেতে পারে। কারণ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বৈরুত বন্দর দিয়েই দেশটির ৮৫ শতাংশ খাদ্যশস্য আমদানি হতো।
দিনের শেষভাগে টেলিভিশনের এক ভাষণে লেবানিজ সরকারের পদত্যাগ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন দিয়াবের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেও নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত তাকে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকার অনুরোধ জানান।
সূত্র: আল জাজিরা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন