লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সমুদ্রবন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও অবহেলাকে দায়ী করছে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে দেশটির বন্দরের কয়েক কর্মকর্তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। ঘটনার চলমান তদন্তের মধ্যেই তাদের গৃহবন্দি করা হল। ঘটনার পর লেবাননে দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের ওপর ক্ষোভে ফুঁসছে বৈরুতবাসী। কিভাবে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল তার ব্যাখ্যা দাবি করছে।
বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্রকার জুড চেহাব বলেন, ‘ বৈরুত কাঁদছে, বৈরুত চিৎকার করছে, মানুষ এখন ক্লান্ত।’ এই মুহূর্তে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন বৈরুতের অধিবাসী ছাদিয়া এলউচি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনিও বলেন, ‘আমি সবসময়ই জানতাম কতগুলো অযোগ্য লোক আর অযোগ্য সরকার এই দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু আমি বলতে চাই এখন তারা যেটা করেছে সেটা ভয়ংকর অপরাধ।’
দেশটির সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিল বলছে, দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হবে। অন্যদিকে অ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিস্ফোরণের ঘটনায় স্বতন্ত্র তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা সরকারি তদন্তের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে।
বিস্ফোরণে পুরো বন্দর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দু’দিন পর হলেও সরকারের পক্ষ থেকে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। তাই নিজেরাই ঝাড়– হাতে তুলে নিয়েছে বৈরুতের শত শত তরুণ-তরুণী।
সরকার ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজধানী বৈরুতের ক্ষতিগ্রস্ত মার মিকাইল জেলার স্বেচ্ছাসেবী তরুণী মেলিসা ফাদলাল্লাহ। প্লাস্টিক গ্লাভস ও মাস্ক পরে আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে বুধবার বৈরুত বন্দরের কাছেই রাস্তা ঝাড়– দিতে দিতে তিনি এক টুকরো গ্লাস রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রশাসনিক ভবনের মধ্যে ছুড়ে ফেলেন।
বলতে থাকেন, ‘আমার কাছে এটা এই রাষ্ট্র একটা নর্দমার মতো। নর্দমাতুল্য এই রাষ্ট্রের কারণেই মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে। বহু মানুষ হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই রাষ্ট্র নর্দমাই থেকে যাবে।’
বৈরুত কাঁপানো সেই বিস্ফোরণে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৪ হাজারের বেশি। সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি আর অদক্ষতার কারণেই এত নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হল বলে মনে করছে লেবানিজ জনতা।
এএফপিকে ফাদলাল্লাহ বলেন, ‘আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এই রাষ্ট্রটাকে মেরামত করার চেষ্টা করছি আমরা। গত নয় মাস ধরেই আমরা লড়াই করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা যদি প্রকৃত রাষ্ট্রই হতো, মঙ্গলবার রাতেই পরিষ্কার ও উদ্ধার অভিযানের জন্য সরকার রাস্তায় থাকত। কিন্তু কোথায় তারা।’
বিস্ফোরণে পরই বৈরুতের বন্দরে বিপুল পরিমাণ বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুতের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। বন্দরটিতে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রাখা ছিল বলে জানা গেছে। এটি মূলত বোমা ও সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, এ রাসায়নিক থেকে বিস্ফোরণেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বৈরুতের অর্ধেকটা। দুর্ঘটনার পর থেকেই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। কার দোষে ঘটল এমন মর্মান্তিক ঘটনা, উঠছে সেই প্রশ্নও। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া সরকারি নথির ছবি থেকে জানা গেছে, অন্তত ছয় বছর ধরে লেবানিজ কর্মকর্তারা বন্দরে এমন বিপদের কথা জানতেন।
বুধবার সরকারের এক জরুরি বৈঠকে লেবাননের প্রেসিডেন্ট মাইকেল আউন বলেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় গুদামে রাখা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, গুদামটিতে ছয় বছর ধরে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অনিরাপদ অবস্থায় পড়ে ছিল। ২০১৩ সালে একটি জাহাজে করে এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বৈরুত বন্দরে পৌঁছায়। ওই সময় এগুলো আটক করা হয়। রাসায়নিক বহনকারী জাহাজটি মোজাম্বিক যাওয়ার কথা ছিল।
বৈরুত বন্দরের প্রধান এবং কাস্টমস প্রধান বাদরি দাহের বলেন, তারা জানতেন- অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিপজ্জনক এবং বন্দরের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানে রাখা রাসায়নিক পদার্থ রফতানি কিংবা বিক্রি করে দেয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে একাধিকবার চিঠি লেখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী নাদা চেমালি লেবাননের রাজনীতিকদের মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এরাই দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাদের বাড়ি যাও।’ বিস্ফোরণে তার দোকান ও বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তা মেরামতে সরকারের কোনো সহযোগিতার প্রত্যাশা করছেন না।
চিমালি চিৎকার করে বলেন, কে আমাদের সহযোগিতা করবে? কে আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে?
বন্দর এলাকার কাছাকাছি থাকা কয়েকটি হাসপাতালে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুটি হাসপাতালের অবস্থা এতই খারাপ যে সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কবে পুনরায় চালু হবে সেটির কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না।
বৈরুতের বাসিন্দাদের মতো হাসপাতালগুলোও সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাবে বলে মনে করে না। অনেকের কাছে ক্ষোভের বড় কারণ হল দেশের সর্বশেষ এই বিপর্যয় কোনো ঐতিহাসিক বিরোধের জের ধরে হয়নি। একটি নিজেদের ডেকে আনা।
ড. ডমিনিক ডাউ বলেন, আমাদের নেতাদের মুখ্য অবহেলা না হয়ে ইসরাইলি হামলা হলেই ভালো হতো। নিজেদের দ্বারা আহত হওয়ার চেয়ে তা অনেক বেশি সহজে মেনে নেয়া যেত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন