দফায় দফায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে ভারতের দাদাগিরি। মহাপরাক্রমশালী চীন আর চিরশত্রু পাকিস্তান তো বটেই, আজকাল পুঁচকে নেপাল-ভুটানেরও হুমকিধমকি খাচ্ছে ভারত! বিশেষ করে নেপাল তো লাগাতারভাবে একের পর এক ধাক্কা দিয়ে ভারতকে তটস্থ করে রেখেছে। কখনও ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা জমি নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করছে। কখনও ভারতের সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করছে। কখনও আবার ভারতের বাঁধ মেরামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মজার বিষয় হলো এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ফলে নেপালের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে। অন্যদিকে যেই ভুটানকে ভারতের হাতের পুতুল ভাবা হতো সেই দেশটিও এখন ভারতীয় পর্যটকদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের কৃষকদের সেচের পানি দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ যে এই অঞ্চলে শেকড় শক্ত করছে, নেপাল ও ভুটানের এসব পদক্ষেপ তারই প্রমাণ। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে যে, উপমহাদেশে কি ভারতের আধিপত্য আর কর্তৃত্ববাদের দিন শেষ? ভারত কি ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে?
মুঠোর বাইরে দুই গুটি
কিছুদিন আগেও দেখা যেত যে, ভারত যা বলতো, পাকিস্তান বাদে উপমহাদেশের অন্য দেশগুলো সেই পথেই চলতো। আর নেপাল ভুটানকে ভাবা হতো ভারতের মুঠোয় থাকা দুই গুটি। কিন্তু সেই দিন এখন আর নেই। দিল্লির মুঠো থেকে বেরিয়ে এখন নেপাল ভুটান ভারতকেই মুষ্ঠীবদ্ধ করে ঘুষি পাকাতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ছলচাতুরি
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়া এখন উপমহাদেশে ভারতের কোনো বন্ধুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধুমাত্র বাংলাদেশের কারণেই ভারত জঙ্গীবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইস্যুতে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারছে। অথচ নরেন্দ্র মোদির সরকার এর কোনো প্রতিদান তো দিচ্ছেই না, উল্টো বাংলাদেশের সঙ্গে ছলচাতুরি আর প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। গত বছর পেঁয়াজ নিয়ে যেটা হলো সেটা কারোরই অজানা নয়। আর এবার করোনা সংকটেও ভারত বাংলাদেশের জন্য কিছু তো করছেই না, উল্টো বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
চীনের চাপ
সারা বছর পাকিস্তানকে সামলাতে ব্যস্ত থাকা ভারত এবার চীনের চাপে রীতিমতো পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভারতের ভেতরে চীনের সেনারা ঢুকে আস্তানা গেড়ে ফেলল, ২০ জন ভারতিয় সেনাকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো। অথচ ভারত শুধু দর্শক হয়ে সবকিছু দেখে গেল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দু’একবার আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছেন মাত্র। কিন্তু সেটাকে বিড়ালের ‘মিউ মিউ’ ডাকই মনে হয়েছে। সীমান্তে চীনের চাপ ছাড়াও চীনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের কাছেও পর্যুদস্তু হচ্ছে ভারত। চীন একের পর এক দেশকে পকেটে পুরে ফেলছে, এটা অজানা কোনো বিষয় নয়। চীনের ঋণের জালে পা দিয়ে শ্রীলঙ্কার আটকে পড়ার খবরটাও পুরোনো হয়ে গেছে। ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা চীনের সামনে ভারত যেন ঠক ঠক করে কাঁপছে।
মাঠে ইমরান
উপমহাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী নিঃসন্দেহে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে এই দুজনের গ্রহণযোগ্যতা যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, মোদির চেয়ে ইমরান এগিয়ে আছেন যোজন যোজন ব্যবধানে। উদার এবং সহনশীল হিসেবে পরিচিত ভারতকে মোদি একটি কট্টরপন্থি এবং অসহিষ্ণু রাষ্ট্রের তকমা এনে দিয়েছেন। অন্যদিকে ইমরান খান ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং জঙ্গীবাদের দেশ পাকিস্তানকে বহির্বিশ্বে নমনীয় হিসেবে তুলে ধরছেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেদেশি রাষ্ট্রনায়কদের ফন দিচ্ছেন, কথা বলছেন। এটা ইমরানের ভান বা অভিনয় যা-ই হোক না কেন বহির্বিশ্বে এর ফলে ইমরান খানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। হার্টথ্রব ক্রিকেটার হওয়ার কারণেই হোক কিংবা অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী বলেই হোক, ইমরান খানকে যেকোনো সময়ের পাক রাষ্ট্রনায়কদের চেয়ে বেশি ইতিবাচক মনে করছে বহির্বিশ্ব। দেশে ইমরানের জনপ্রিয়তা যত কমই হোক না কেন, বিদেশে ভালো একটি ইমেজ দাঁড়িয়ে গেছে তার। এমনকি এটাও দেখা যাচ্ছে যে, অনেক মানুষ পাকিস্তানকে অপছন্দ করলেও ইমরানকে পছন্দ করছে। এটাও পরোক্ষভাবে ভারতের বিপক্ষেই যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ভারত বিদ্বেষ বাড়ছেই
একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি যেমনই হোক না কেন সেই দেশের জনগণ এবং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীকেই ভাবা হয় দেশটির আসল পরিচয়। সেদিক থেকে যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে, শুধু এই উপমহাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। দিল্লির স্বার্থপর আচরণের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের মধ্যে তীব্র ভারত বিদ্বেষ কাজ করে। আর নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর সেই বিদ্বেষ বেড়ে গেছে বহুগুণে।
চীন-পাকিস্তান হাতে হাত
ভারতের দুই শত্রু চীন এবং পাকিস্তান এখন প্রকাশ্যেই হাতে হাত মিলিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। বিগত পাক সরকারগুলোর সময় দেখা গিয়েছিল যে, তারা চীনকে দূরে ঠেলে আমেরিকাকে বেশি আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু এখন ইমরান খান কিছুটা ভিন্ন পথ নিয়েছেন। তিনি বেইজিংকে কাছে টানছেন আবার আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছেন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্রিটিশদের বাণিজ্যের নামে সাম্রাজ্যবাদ বহু আগেই শেষ হয়েছে, মার্কিনিদের জঙ্গী দমনের নামে সাম্রাজ্যবাদের দিনও শেষের পথে, সেই জায়গাটা নিতেই হয়তো এখন আসছে চীনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। এর ফলে উপমহাদেশে ভারতের চিরচেনা আধিপত্যের পতন অসম্ভব কিছু নয়। এই পতন ঠেকাতে ভারতের বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো। কিন্তু কর্তৃত্বপরায়ণ এবং অন্যায্য আচরণ করে সেই দেশগুলোকে ক্রমেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে ভারত। এর পরিণতি মোদির দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন