কাশ্মীরকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানোর কার্যক্রম শুরু করেছে ভারত। গত ১৮ মে’র পর থেকে এই পর্যন্ত পঁচিশ হাজার ভারতীয়কে কাশ্মীরে বসবাসের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের হিমালয় অঞ্চলে জনসংখ্যার একটা ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। এই আবাসন সার্টিফিকেট একপ্রকার নাগরিকত্ব অধিকার। এই অধিকার বলে এখন তারা কাশ্মীরে বসবাস, সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারবে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সম্বলিত ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (এ) অনুচ্ছেদের ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত। এ ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরের বাইরের কারো কাশ্মীরে এসে সরকারি চাকরি, নাগরিকত্ব অধিকারের জন্য আবেদন করতে পারতো না। কিন্তু এখন নতুন আইনে বলা হয়েছে, যে কেউ কাশ্মীরে যদি ১৫ বছর ধরে বসবাস করে অথবা এই অঞ্চলে সাত বছর ধরে পড়াশোনা করে এবং দশম বা দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়, তাহলেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। ভারতীয় সরকারি কর্মচারীদের যে সন্তানরা কাশ্মীরে দশ বছর পরিষেবা দিয়েছে, তারাও এই আবেদন করতে পারবে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের শীর্ষ আমলা রয়েছেন ৬৬ জন। এরমধ্যে ৩৮ জনই কাশ্নীরের বাইরের, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের। এরা কাশ্মীরে ব্যাংক, ডাকঘর, টেলিযোগাযোগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে।
কাশ্মীর হবে আরেক ফিলিস্তিন
গত শুক্রবার ভারতের বিহার রাজ্যের আদিবাসী নবিনকুমার চৌধুরীকে দেয়া কাশ্মীরের আবাসন সার্টিফিকেটের একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই টনক নড়ে সবার। শ্রীনগরের বাসিন্দা বদরুল ইসলাম আল জাজিরাকে বলেন, ‘কাশ্মীর আরেকটি ফিলিস্তিনে পরিণত করার সর্বশেষ কার্যক্রমটি শুরু হলো। খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। আমাদের এমন একটা সময় আসবে, যখন আমরা ঘরেও নিরাপদ থাকবো না।’
শ্রীনগরের মানবাধিকার কর্মী খুররাম পারভেজ বলেছেন, ‘এই পদক্ষেপটি পুরো অঞ্চলের জন্য বিপর্যয়কর। লকডাউনের সুযোগে সরকার খুব তাড়াতাড়িই কাজটি সারতে চাইছে।’
গত শুক্রবার এক টুইট বার্তায় ভারতের এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ। টুইটে তিনি বলেছেন, ‘ভারত সরকারের এই পদক্ষেপের পেছনে ঘৃণ্য নীল নকশা দেখতে পাচ্ছি।’
কাশ্মীরে হিন্দুদের আবাসন সার্টিফিকেট দেয়ার উদ্যোগটি আরএসএস-বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদী’ এজেন্ডার অংশ বলে বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘কাশ্মীরিরা এই বোগাস আধিপত্য সার্টিফিকেট প্রত্যাখ্যান করবে। কারণ ভারতের এই নিয়ম অবৈধ। জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের প্রস্তাবসমূহ এবং চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এই নিয়ম কাশ্মীরিদের তাদের নিজস্ব ভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে।’
কোন অঞ্চলে কতটি আবাসন সার্টিফিকেট বিতরণ
সবচে বেশি সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে জম্মুতে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের ১০ টি জেলায় আবাসন সার্টিফিকেটের আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৩৩ হাজার। এরমধ্যে পঁচিশ হাজার জনকে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। দোদা জেলায় দেয়া হয়েছে সাড়ে আট হাজার। এ জেলায় মুসলিম ৫৩.৮১ শতাংশ এবং হিন্দু ৪৫. ৭৬ শতাংশ। রজৌরি জেলায় দেয়া হয়েছে ৬২১৩ টি সার্টিফিকেট। এ জেলায় মুসলিম ৬২. ৭১ শতাংশ এবং হিন্দু। সীমান্ত জেলা পুঞ্চেতে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে ৬১২৩টি। এখানে ৯০. ৪ শতাংশ মুসলিম।
কাশ্মীর অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিমদের হার ৯৬.৪ শতাংশ। এ অঞ্চল থেকে আবাসন সার্টিফিকেটের আবেদন জমা পড়েছে ৭২০ টি। আবেদন ইস্যু করা হয়েছে ৪৩৫টি।
শ্রীনগরের মানবাধিকার কর্মী খুররাম পারভেজ আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, কাশ্মীরের স্থানীয় সরকারকে নয়াদিল্লি আদেশ দিয়েছে—১৪ দিনের ভেতরেই যেন আবাসন সার্টিফিকেটের আবেদনগুলো ইস্যু করা হয়। নয়ত কর্মকর্তাদের জনপ্রতি ৫০ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অথচ আসামে বিজেপি সরকার প্রতিটি নাগরিকত্ব আবেদন যাচাই করে দেখেছে। ফলে ২ মিলিয়ন মানুষ চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে তার বালাই নেই। আাসামে তো একজনের নাগরিত্ব নিয়ে আরেকজন ভ্যাটো দিতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরে তাও পারে না। যা হচ্ছে, সব মেনে নিতে হচ্ছে। বরং যারা এর বিরোধিতা করবে, তাদেরকে জেলে বন্দী করারও হুমকি দেয়া হয়েছে।’
সূত্র : আল জাজিরা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন