করোনা ভাইরাসে ইতালিতে যখন আক্রান্তের সংখ্যা সবেমাত্র সাড়ে ৩ হাজার এবং মারা গিয়েছিল ১৪৮ জন, সময় গত ৬ মার্চ। তখনও ইতালির বেশিরভাগ মানুষ এই ভাইরাসকে গুরুত্ব দেওয়ার বদলে নানা গুজব ও ভুয়া খবরে বিশ্বাস করে মেতে ছিল আড্ডাবাজিতে। করোনা অবহেলায় ততক্ষণে ভেতরে ভেতরে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
তারপর এক মাসও পেরোয়নি। কিন্তু ইতালি বর্তমানে সেই করোনা ভাইরাসেই সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ। সেখানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে এখন ১২ হাজার ছাড়িয়েছে, আর আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে কয়েকদিন আগেই।
এছাড়া ৮ মার্চ লম্বর্ডিয়াসহ গোটা উত্তর ইতালিকে সরকার লকডাউন করে দেয়। কিন্তু আড্ডাবাজ নগরবাসীদের তা মানাতে গলদঘর্ম হচ্ছিল প্রশাসন।
ইতালির বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই, যে এই মাসের শুরুতেও আড্ডাবাজি, নানা গুজব ও ভুয়া খবরের পেছনে কেমন ছুটছিলেন ইতালীয়রা। ওই সময় সোশাল মিডিয়ায় কয়েকটি ঘটনা ভাইরাল হয়, পরে বিবিসিতে দেখা যায়, যা পুরোপুরি ভুয়া ছিল।
এর মধ্যে কয়েকটি হলো- মার্চ মাসের প্রথম দিকে ইতালির রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখা যাচ্ছে, এমন একটি ভিডিও টুইটারে পোস্ট করার পর সেটি আড়াই লাখ বার দেখা হয়েছিল। ভিডিওতে প্রথমে বলা হয়েছিল, এসব গাড়ি দক্ষিণাঞ্চলীয় ফজজা শহরে, পরে সংশোধন করে বলা হয় সিসিলির পালেরমোতে।
আরও বলা হয়, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কারাগারে দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর, কারাগারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ওই সব গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে। সেনা মোতায়েনের খবরটি ছিল ভুয়া।
কিন্তু, ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পালেরমোর রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো ছিল সেটা সত্য, কিন্তু সেগুলোর সাথে কারাগারে অস্থিরতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ষষ্ঠ ল্যানসিয়েরি দি আওস্টা রেজিমেন্টের ওই যানগুলো সার্দিনিয়ায় সামরিক মহড়া শেষে ফিরছিল এবং সেগুলোর সঙ্গে কারাগারে অস্থিরতা বা করোনা ভাইরাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।
পর্যটন নগরী ভেনিসের একটি এলাকার দোকান ও বাড়ি বাড়িতে একটি লিফলেট ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে লেখা ছিল কভিড-১৯ প্রতিরোধে অস্ট্রেলিয়ায় টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ড তা কিনেছে।
লিফলেটে আরও বলা হয়, ভ্যাকসিনের ছয়টি ডোজ নিলে এক বছরের জন্য করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে এবং মাত্র ৫০ ইউরোয় সেটি পাওয়া যাবে। যোগাযোগের জন্য একটি ইমেইল অ্যাড্রেসও দেওয়া হয়েছিল সেখানে। টিকা কিনা ও সেই লিফলেটের খবরটিও ছিল ভুয়া।
তবে প্রকৃত বাস্তবতা হল বিশ্বে এখনও করোনা ভাইরাসের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ তা হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশকারী একটি ইতালিয়ান সাইট বলেছিল, “টিকার অস্তিত্ব নেই। তবে যেটা আছে সেটা হল মিথ্যা বলে লোকজন মজা নিচ্ছে।”
করোনা ভাইরাস মোকাবেলার নানা ধরনের পদ্ধতি (টোটকা) সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল, চীনের জানজান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলেছেন, করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে যত বেশি পারা যায় ভিটামিন সি খেতে হবে।
ভাইরাল ম্যাগাজিন ডট আইটি নামে একটি নিউজ পোর্টালে এটা প্রকাশিত হওয়ার পর সেটির ভিউ হয়েছিল ৫ লাখ ৭৬ হাজার, আর্টিকেলটি শেয়ার হয়েছিল ৩০ হাজার ।
ওই পোস্টে ‘প্রফেসর চেন হোরিন সিইও অফ দ্য বেইজিং মিলিটারি হসপিটাল’কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে, লেবু রস মিশ্রিত গরম পানীয় করোনা ভাইরাসের বিস্তার কমাতে পারে। লেবুর সরবত পানের ওই খবরটিও ভুয়া ছিল।
তবে ওই পোস্টের অনেক কিছুই সঠিক ছিল না বলে বিবিসির প্রতিবেদনের উঠে এসেছে।
প্রথমত, চীনা ওই গবেষক ভুয়া বলে মনে হয়। কারণ তার নাম ইংরেজি অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘হোয়াট ইজ ইওর নেইম (তোমার নাম কি)’। চীনে জানজান বিশ্ববিদ্যালয় বলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর আগে ক্যান্সার নিয়ে ভুয়া পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ওই প্রফেসরের কথা বলা হয়েছিল। তাছাড়া লেবুর সরবত বা প্রচুর ভিটামিন সি এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে তা এখনও প্রমাণিত নয়।
এরপর হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ ছড়িয়ে পড়ে লোকজনকে জীবাণুনাশক দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া ও গার্গল করার পরামর্শ দিয়ে। সেখানে বলা হয়, ভাইরাস যাতে ফুসফুসে যেতে না পারে সেজন্য গার্গল করতে হবে। তবে ঘন ঘন হাত ধোয়া উপকারী হলেও গার্গল করা কোনো কাজে দেয় বলে জানা যায়নি।
ইতালির সাধারণ জনগন যখন এইসব ভুয়া খবর ও গুজবে বিশ্বাস করে আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত ছিল। ততক্ষণে এই ভুয়া খবর ও গুজবই তাদের জন্য কাল হয়ে গেছে। ডেকে এনেছে মারাত্মক বিপর্যয়। এবং তখনও তাদের ঘোরাঘুরি বন্ধ না হওয়ায় তা অধিক মাত্রায় ছড়াতে সাহায্য করে। ভেতরে ভেতরে বহুলোক আক্রান্ত হয়ে গেছে। সেজন্য একমাস না পেরোতেই দেশটি ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। সেখানে পরিস্থিতি এত সংকটময় যে, হাসপাতালে রোগী রাখার জায়গা নেই, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর নেই। জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। এমনকি মৃতদের সৎকারের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ জায়গারও সংকট দেখা দিয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন