রোগ একই, কিন্তু মৃত্যুর হারে পার্থক্য। করোনা ভাইরাসে একেক দেশে একেক রকম মৃত্যু হার। কিন্তু কেন এই পার্থক্য? স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, সব দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এক নয়, আবার ভিন্ন ভিন্ন দেশের সরকারের নীতি-কৌশলও ভিন্ন ভিন্ন। কোনও দেশ হয়তো উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা ও সময়মতো যথাযথ প্রতিরোধ কৌশল গ্রহণের কারণে মৃত্যুর হার কমিয়ে রাখতে পেরেছে। আবার ইতালির মতো দেশ শুরুতে গুরুত্ব না দিয়ে এখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হতে চলেছে। আবার পাকিস্তান নিয়েছে ভিন্ন নীতি। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নির্বাসনে পাঠানোর দিকেই বেশি মনোযোগী দেশটি।
বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন। অর্থাৎ আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। ইতালিতে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ৭৩৯ জন আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছেন ১১ হাজার ৫৯১ জন। মৃত্যুর হার ১০ দশমিক ২ ভাগ। স্পেনে মোট আক্রান্ত ৮৭ হাজার ৯৫৬, মৃত্যুহার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। জার্মানিতে মৃত্যুর হার মাত্র দশমিক ৬ ভাগ।
মৃত্যুহারের এই হিসাবটি আরও সহজ করে বললে- জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি দশ লাখে ইতালিতে মারা যাচ্ছেন ১২৪ জন, স্পেনে দশ লাখে ৭৮ জন, ইরানে ২৫ জন, ফ্রান্সে ২০ জন, যুক্তরাজ্যে ৭ জন আর চীনে ২ দশমিক ৩ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই মৃত্যুহারের পার্থক্যের কিছু কারণ চিহ্নত করেছে। এক্ষেত্রে কোনও দেশের জনসংখ্যার বয়সের অনুপাত, দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা আর সবশেষ কতজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে তার উপর নির্ভর করছে। এর মধ্যে ডব্লিউএইচও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সবশেষ কতজনকে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটির ওপর।
জার্মান অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেয়াস ব্যাকহাউজের হিসাবে, ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত মানুষদের গড় বয়স ৬৩ বছর। জার্মানিতে ৪৫ বছর। জার্মানির তুলনায় ইতালি অল্প বয়সী নাগরিকদের করোনা পরীক্ষায় আওতায় কম আনছে। সেখানে অনেক সম্ভাব্য রোগীই করোনা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এমনকি যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের অনেকেই পরীক্ষা করারই সুযোগ পাননি। তবে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়াতে। দেশটিতে কমপক্ষে তিন লাখ জনগণের করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৯ হাজার মানুষের। ব্যাপক হারে পরীক্ষার কারণে দেশটিতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই এখনও পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, করোনা ভাইরাসে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। সে অনুযায়ী করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুতে বয়সের অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইতালিতে ব্যাপক হারে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাকেই দায়ী করা হচ্ছে। অথচ ইতালি ও জার্মানিতে মানুষের গড় বয়স ৪৬ বছর। অথচ মৃত্যুর হারে দুই দেশের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোন দেশ কবে আক্রান্ত হয়েছে এবং কবে থেকে সেই দেশে আক্রান্তরা মরতে শুরু করেছে এর উপরই মৃত্যুহার নির্ভর করছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জার্মানি এখনও করোনা মহামারির চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছেনি। সেজন্য এখনও দেশটিতে মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। সব দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান সমান নয়। সক্ষমতাও এক নয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোন দেশের স্বাস্থ্যসেবা কতটা সক্ষম সেটিও মৃত্যুহারে বড় ভূমিকা রাখছে। সাধারণত করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোতে দরকার পর্যাপ্ত বেড ও আইসিইউ ব্যবস্থা। যেসব দেশ এসব সুবিধা সর্বোচ্চ পরিমাণে দিতে পারছে তাদের দেশে আক্রান্তরা কম মারা যাচ্ছে।
ইতালিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। দেশটিতে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার সময় সারা দেশে নিবিড় পর্যবেক্ষণ বেড সংখ্যা ছিল ৫ হাজার। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে ৮ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে জার্মানি ২৮ হাজার বেড প্রস্তুত রেখেছে। ফলে তারা রোগীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে। আর তাতে মৃত্যুর হারও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে।
জার্মানিতে প্রতি ১ লাখ মানুষের বিপরীতে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড সুবিধা আছে ২৯টি। যুক্তরাষ্ট্রে আছে ৩৪টি। যেখানে ইতালিতে মাত্র ১২টি, স্পেনে ১০টি। ফলে ইতালি ও স্পেনে মৃত্যুর হারও অন্য দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মাত্র ১০টি নিবিড় পরিচর্যা সুবিধা সম্বলিত শয্যা থাকলেও দেশটি এখনও মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে শুধুমাত্র দেশের জনগণকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন