সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর মোবাইল ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে দৃশ্যমান নম্বর দেখে বোঝা গেল ভারত থেকে এসেছে। রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলোÑ ‘আমি শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন বলছি। আমার দুটি ছেলে অপারেশনে গিয়ে আহত হয়েছে। তাদের চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আপনাকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে।’ ফোন পেয়ে ভড়কে যান তিনি। নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে তিন লাখ টাকাও পাঠান। এর পর, আরও টাকার জন্য হুমকি দিলে ওই প্রকৌশলী ভয়ে পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন, বিষয়টি পুলিশকেও জানান।
শুধু ওই প্রকৌশলীই নন, এমন আরও অনেকের কাছ থেকেই মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকদের একটি চক্র। তবে শেষরক্ষা হয়নি। চক্রের তিন সদস্যকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে অভিনব প্রতারণার চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ডিবি জানায়, চক্রের প্রধান সালেকীন মোস্তফা ভারতের নাগরিক। তিনি ভারতীয় মোবাইল ফোন অপারেটর এয়ারটেলের সিমকার্ড সংগ্রহ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও আরমান পরিচয়ে ফোন করতেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যশোরের বেনাপোল ও দিনাজপুরের হাকিমপুর সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক কাভারেজকে কাজে লাগাত প্রতারক চক্র।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অভিনব কায়দায় প্রতারণাকারী ওই চক্রের ৩ সদস্যকে গাজীপুর ও কল্যাণপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিট। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. বেলায়েত হোসেন ওরফে ইলিয়াস (৪৮), মো. জুয়েল মিয়া (৩০) ও মো. কাইয়ুম ওরফে বাবুল (৪৯)। এ বিষয়ে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ডিবির সূত্র জানায়, এ চক্রের মূল হোতা ভারতের সালেকিন মোস্তফা। সীমান্ত এলাকায় তিনি একাধিক চক্র গড়ে তুলেছেন। চক্রের সদস্যরা বাজার থেকে বিভিন্ন টেলিফোন ডিরেকটরি সংগ্রহের পর সেখান থেকে কিছু লোককে টার্গেট করে এবং তাদের কাছে ফোন করে চাঁদা দাবি করে। এক্ষেত্রে তারা সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতীয় এয়ারটেল সিমের মাধ্যমে ভিকটিমের নম্বরে ফোন দিয়ে বলে, ‘আমি সুব্রত বাইন/আরমানের লোক। বস আপনার সঙ্গে কথা বলবে।’ এর পর সালেকিন নিজেকে সুব্রত বাইন অথবা আরমান পরিচয় দিয়ে বাহিনীর সদস্যরা অপারেশনে গিয়ে আহত হয়েছে বা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। দাবিকৃত টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় চক্রের অন্যান্য সদস্যকে। পরে ওই সদস্য বাংলাদেশি নম্বর থেকে ফোন দিয়ে টাকা দাবি করে এবং বিকাশ নম্বর পাঠায়। যদি ভিকটিম ভয়ে টাকা বিকাশ করে তা হলে সেটি হুন্ডির মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয় সালেকিনের কাছে। যদি কেউ টাকা দিতে রাজি না হন, তা হলে টেলিফোন ডিরেকটরিতে উল্লেখিত কর্মস্থল, স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করে তাকে সপরিবারে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়।
ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের শুটিং ইনসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের এডিসি আশরাফুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে চক্রটি সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। চক্রের মূল হোতা সালেকিন ভারতে অবস্থান করায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছেÑ জানান তিনি।
এডিসি আশরাফুল্লাহ জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেÑ যশোরের বেনাপোল ও দিনাজপুরের হাকিমপুরে গড়ে উঠেছে এ ধরনের চক্র। সালেকিন ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চক্রের সদস্যদের সব রকম কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার ভারতে চলে যায়।
লেকচার পাবলিকেশন্সের জেনারেল ম্যানেজার ও ভুক্তভোগীদের একজন মো. আজহারুল ইসলাম ফরাজী আমাদের সময়কে বলেন, আমি পরিবারসহ রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় থাকি। তিন মাস আগে আমার মোবাইল ফোনে ভারতের একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘আমি সুব্রত বাইনের লোক। বস আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ এর পর সুব্রত বাইন পরিচয় দানকারী লোকটি বলতে থাকেনÑ আমার তিনটি ছেলে (ক্যাডার) গাজীপুরে এক অপারেশনে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। ওদের চিকিৎসায় ১৫ লাখ টাকা লাগবে। ১০ লাখ ম্যানেজ হয়েছে। বাকিটা আপনি দেখবেন। আমি আমার ছেলেপেলেদের বলে দিচ্ছি। ওরা যোগাযোগ করবে। এর পর অন্য নম্বর থেকে টাকার জন্য ফোন আসতে থাকে। বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করার পর তারা আমার কর্মস্থল, বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা এমনকি পরিবারের সদস্যদের তথ্য দিয়ে সপরিবারে হত্যার হুমকি দিতে থাকে। পরে এ বিষয়ে খিলগাঁও থানায় জিডি করি আমি। এর পর তাদের ফোন আসাও বন্ধ হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন