করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ১৫ হাজার যাত্রীসহ আটকে আছে ৪টি প্রমোদতরী। কোয়ারেন্টাইন (অবরুদ্ধ) করে রাখায় জাহাজগুলো গন্তব্যে যেতে পারছে না। জাহাজ থেকে নামতে পারছে না যাত্রীরা। ফলে আনন্দভ্রমণে বেরিয়ে, বর্তমানে বন্দি অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন কাটছে তাদের। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, এএফপি। সিএনএন। আটকে থাকা জাহাজগুলো হলো-
ডায়মন্ড অব প্রিন্সেস
তিন হাজার ৭০০ যাত্রী নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরে আটকে আছে এ জাহাজটি। এখন পর্যন্ত জাহাজের ১৩৫ যাত্রীর শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্ত যাত্রীদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাহাজেই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
ওয়েস্টারডাম
দুই হাজার যাত্রী নিয়ে সাগরে ভাসছে ওয়েস্টারডাম। গত ১ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি হংকং থেকে ছেড়ে আসে। কিন্তু সেটিতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কেউ থাকতে পারে, এই আশঙ্কায় জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছে না কোনও দেশ। ইতিমধ্যে জাপান, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, গুয়ামের বেশ কয়েকটি বন্দর তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। সোমবার জাহাজটির থাইল্যান্ডের লায়েম চাবাং বন্দরে নোঙ্গর করার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে সেই প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছে ব্যাংকক কর্তৃপক্ষ।
ওয়ার্ল্ড ড্রিম
পাঁচদিন ধরে তিন হাজার ৬০০ যাত্রী নিয়ে হংকং বন্দরে আটকে আছে এই জাহাজটি। এর পুরোনো কিছু যাত্রীর শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বর্তমান যাত্রীদের। তবে এখন পর্যন্ত সেখানে নতুন করে কেউ আক্রান্ত হয়নি।
অ্যান্হিম অব দ্য সি
সাড়ে ছয় হাজার যাত্রী নিয়ে ২দিন ধরে আটকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি বন্দরে। গত শনিবার জাহাজটির বন্দর ছাড়ার কথা ছিল। তবে এর ৪ যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য তারাসহ ২৭ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফলে আটকে যায় জাহাজটির গন্তব্যে ফেরা।
তবে পরীক্ষায় কারও ভাইরাস সংক্রমণ ধরা না পড়ায়, অবশেষে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে ক্যারিবিয়ান জাহাজটি। ফ্লোরিডা হয়ে বাহামা যাওয়ার কথা থাকলেও সোমবার সরাসরি বারমুডার উদ্দেশে যাত্রা করেছে এটি।
এদিকে করোনা ভাইরাসে গত ২৪ ঘণ্টায় চীনে ১০৮ জন নিহত হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত একদিনে সবচেয়ে বেশি মারা যাওয়ার রেকর্ড। করোনা ভাইরাসে চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। চীনের বাইরে হংকং ও ফিলিপাইনে ১ জন করে মোট ১ হাজার ১৮ জন নিহত হয়েছে। যা ২০০২-২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বেড়ে চলেছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত এই ভাইরাসে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ হাজার ৬৩৮ জন এবং চীনের বাইরে ৪৬২ জন। সবমিলিয়ে পুরো বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ হাজার ১১০ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪ হাজার ২৬ জন। মঙ্গলবার দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এ তথ্য জানিয়েছে। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। এএফপি।
মঙ্গলবার সকালে চায়নার জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, চীনে গত এক দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৭৮ জন। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৪২ হাজার ৬৩৮ জন। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ জনের অবস্থা ভয়াবহ বলে জানানো হয়েছে। পর্যবেক্ষণে রয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। এছাড়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪ হাজার ২৬ জন।
হুবেই প্রদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হুবেইতে নতুন করে ২ হাজার ৯৭ জন আক্রান্তের খবর নিশ্চিত করেছে। এ নিয়ে প্রদেশটিতে নিহত হয়েছে ৯৭৪ জন, আক্রান্ত হয়েছে ৩১ হাজার ৮১৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১০৮ জনের মধ্যে ১০৩ জনই হুবেইতে, বাকি ৫ জন মারা গেছে চীনের অন্যান্য এলাকায়।
হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৫২ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। সেখানাকারই একটি সামুদ্রিক খাদ্য ও মাংসের বাজার থেকে এই করোনা ভাইরাসটির উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভাইরাসটি যাতে ছড়িয়ে না যায়, সেজন্য চীন হুবেই প্রদেশকে পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ওই অঞ্চলের সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে চীনসহ বাইরের বিশ্ব থেকে। এছাড়াও দেশটির ২০টি প্রদেশের ৮০টি শহরকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে বাইরের দুনিয়া থেকে।
চীনে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ৪ হাজার ২৬ জন সুস্থ হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর তাদেরকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত ৪ হজার ২৬ জন মানুষ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ আক্রান্তের খবর আসছে, তাতে আক্রান্তের আসল খবর জানা যাচ্ছে না। কারণ, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, শুধু তাদের হিসেব পরিসংখ্যানে ধরা হচ্ছে। তাই এর প্রকৃত হিসেব বের করা বা জানা খুবই কঠিন ব্যাপার, যা আরেকটি আশঙ্কার কারণ।
চীনের সবগুলো প্রদেশসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। চীনের বাইরে এ পর্যন্ত ৪৬২ জন আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
ভাইরাস সংক্রমণের কারণে চীন ভ্রমণে সতর্কতা, নিষেধাজ্ঞা জারি এবং কড়াকড়ি আরোপ করেছে অনেক দেশ। ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ চীন থেকে আগত যাত্রীদের ভিসা বাতিল করেছে। ভাইরাসের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের চীন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। চীনে অধিকাংশ বিমান সংস্থার ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্সসহ আরও অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের চীন থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
গুয়াংডং-সহ দেশটির যেসব প্রদেশের বাসিন্দা ৩০ কোটির বেশি সেসব শহরে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু দেশটির কারখানাগুলোতে দিনে মাত্র ২ কোটি মাস্ক তৈরির সক্ষমতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানবিষয়ক বিভাগের মুখপাত্র তিয়ান ইউলং। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ ইউরোপ, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাস্ক আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কাজাখস্তান, হাঙ্গেরিসহ বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশ মেডিকেল সহায়তায় হাত বাড়িয়েছে।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৫টির মতো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া, নেপাল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তাইওয়ান ও ইসরায়েলস ২৫টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগীকে শনাক্ত করা হচ্ছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন