টানা সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর বদলি হয়েছেন লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার। পরবর্তী মিশনের জন্য তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামী মাসে তিনি লেবানন থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট বৈরুত দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদান করেন। তিনি লেবাননে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। একইসঙ্গে তিনি সাইপ্রাসেরও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন।
সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনকালে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণে নানা যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অবৈধ হয়ে যাওয়া প্রবাসীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা কর্মসূচি, অসুস্থ প্রবাসীদের চিকিৎসা ও বৈধকরণ প্রক্রিয়া, নিহত প্রবাসীদের মরদেহ দেশে দ্রুত প্রেরণ, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) প্রদান।
তিনি প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি বাংলাদেশি অধ্যুষিত সাবরা বাজার পরিদর্শন করে প্রবাসীদের খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। এছাড়া সাম্প্রতিক ডলার সংকটে প্রবাসীদের দুর্ভোগ নিরসনে লিবান পোস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ লেবাননের নানা সরকারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, দেন দরবার করেন।
এসব কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছিল লেবাননে অবৈধভাবে দীর্ঘদিন বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার সুযোগ। রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে এই বিশেষ সুযোগ অর্জিত হয়।
দীর্ঘদিনের জরিমানা মওকুফ করে শুধু এক বছরের জরিমানা বাবদ নারীদের ২০০ মার্কিন ডলার এবং পুরুষদের ২৬৭ মার্কিন ডলার এবং বিমানভাড়া বাবদ ৩০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ সাপেক্ষে এই সুযোগ নিতে পারছেন অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশে দূতাবাসের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় এরই মধ্যে নিবন্ধন করা ২৫০০ জনের মধ্যে প্রথম দফায় ৪৯০ জন অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা প্রক্রিয়ায় আছেন।
এছাড়া রাষ্ট্রদূতের নেয়া বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা কর্মসূচিও অসহায় প্রবাসীদের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। লেবাননে জাতিসংঘের শান্তিমিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিজয়ের চিকিৎসা ইউনিটের সহায়তায় এ পর্যন্ত ১৩টি ক্যাম্পে প্রায় পাঁচ হাজার লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি এই কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন।
রোববার (২৬ জানুয়ারি) বৈরুত দূতাবাসে এই বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা কর্মসূচির ১৩তম ক্যাম্পে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার।
তিনি বলেন, ‘লেবানন থেকে আমার বিদায় নেয়ার সময় এসেছে। খুব শিগগিরই আমি আমার দায়িত্বভার ত্যাগ করে লেবানন থেকে বিদায় নেব। তবে এখানে আমার দীর্ঘ সাড়ে চার বছরে যতটুকু সম্ভব সাধারণ প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করেছি। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি যে মানুষসেবা করার সুযোগটা সবাই পায় না কিন্তু আমি সেই সুযোগটা আপনাদের স্বার্থে সদ্ব্যবহার করেছি। হাজার হাজার প্রবাসী আমার জন্য দোয়া করেছে। আমার জন্য আপনার দোয়া করবেন। আমিও আপনাদের জন্য দোয়া করছি।
প্রবাসীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যে উদ্দেশে লেবাননে এসেছেন, আপনাদের সেই উদ্দেশ্য আল্লাহতায়ালা কবুল করুন। আমি আমার দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করছি আমার চলমান কাজগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়।
রাষ্ট্রদূতের এমন আবেগঘন বক্তব্য শুনে দূতাবাসের হলভরা প্রবাসীরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেককে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আজ উনার বক্তব্য শুনে আমরা সত্যিই মর্মাহত ও ব্যথিত। উনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন সেটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের মনকে মানাতে পারছি না। শত প্রতিকূলতার মাঝেও উনি সাধারণ প্রবাসীদের জন্য যথেষ্ট কাজ করেছেন। লেবাননের আনাচে-কানাচে প্রবাসীদের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠান করেছেন। অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। অবৈধদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেছেন। উনার অবদান লেবাননপ্রবাসীরা আজীবন মনে রাখবেন। উনার চলে যাওয়াতে আমরা অভিভাবক হারা হয়ে পড়ব। দোয়া করি সৃষ্টিকর্তা যেন উনাকে সুস্থ, সুন্দর রাখেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন