মাত্র রোগীর জন্য ওষুধ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। মস্তিষ্কের একটি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত আট বছরের এক শিশুকে এই ওষুধ দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি বাংলা, ‘ব্যাটেন ডিজিজ’ নামের মস্তিষ্কের একটি ভয়াবহ এবং দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত শিশু মিলা মাকোভেক।
তার চিকিৎসায় এক বছরের কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন চিলড্রেন হাসপাতালের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন।
এই ওষুধ শুধু মিলার ডিএনএ ত্রুটি সারাতে সহায়তা করবে। এর ফলে তার মূর্ছা যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে, যদিও তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়।
ব্যাটেন ডিজিজের এর ফলে ক্রমে মস্তিষ্কের নিউরনে ক্ষয় হতে থাকে, স্নায়ুর সমস্যা তৈরি হয় এবং চোখের রেটিনা আক্রান্ত হয়। এটি বিরল রোগটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমস্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে এবং এবং সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয় না।
তিন বছর বয়সে মিলার ডান পা ভেতরের দিকে ঘুরে যেতে শুরু করে। এক বছর পরে তার দৃষ্টিশক্তি এতটাই কমে যায় যে, মুখের কাছে ধরে তাকে বই পড়তে হতো। পাঁচ বছর বয়সে এসে সে প্রায়ই পড়ে যেতো এবং ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে সমস্যায় পড়ে।
একপর্যায়ে ছয় বছর বয়সে মিলা অন্ধ হয়ে যায়, খুব কম কথা বলতে পারত আর প্রায়ই মূর্ছা যেতো।
জিনগত বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণে এই রোগটি তৈরি হতে পারে। যার ফলে কোষের ভাঙন বন্ধ এবং বর্জ্য পরিশোধন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে শরীরের ভেতরের আবর্জনার জন্ম হতে থাকে, শেষপর্যন্ত মস্তিষ্কের কোষগুলো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
মিলার পরিবার ‘মিলা'স মিরাকল ফাউন্ডেশন’ নামের একটি প্রচারণা শুরু করেন এই আশা নিয়ে যে, তারা মিলাকে আরোগ্য করে তুলতে পারবেন।
এই প্রচারণার মাধ্যমে মিলার সন্ধান পান ড. টিমোথি ইয়ু। মিলার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এরপরে তাদের বেশ দ্রুত সাক্ষাৎ হয়।
তাদের চিকিৎসক দলটি মিলার ডিএনএ-র জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন মানচিত্র) তৈরি করে, তার জেনেটিক কোড বের করে এবং দেখতে পায় যে, জিনের একটি অভিনব পরিবর্তন হয়ছে।
ত্রুটি শনাক্ত করতে পারায় গবেষকেরা চিন্তা করতে শুরু করলেন যে, রোগটির একটা চিকিৎসা পদ্ধতি তারা খুঁজে বের করতে পারবেন।
তারা একটি ওষুধের নকশা করার পরে গবেষণাগারে মিলার কোষ এবং পশুর ওপর সেটির পরীক্ষা করলেন। সফলতা পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন থেকে স্বীকৃতিও পাওয়া গেল।
এরপরে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ‘মিলাসেন’ নামের ওই ওষুধ দিয়ে মিলার চিকিৎসা শুরু করা হয়।
সাধারণত কোনো ওষুধের আবিষ্কার, ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রোগীদের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় ১৫ বছর লেগে যায়।
সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই চিকিৎসক দলটি মাত্র এক বছরে ওষুধটি আবিষ্কার করে প্রয়োগ করেছে।
ড. টিমোথি বলেন, ‘যখন আমরা কাজটি শেষ করে পেছনের দিকে তাকালাম, আমরা খুব গর্ববোধ করলাম আর অবাক হলাম। মাঝে মাঝে অবুঝের মতো হওয়াটা ভালো, বিশেষ করে আমরা যখন জানি একটি শিশুর আয়ু কমে যাচ্ছে। তখন টিমের সবাই অসাধারণ দ্রুত গতিতে কাজ করার তাগিদ বোধ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জানা মতে এমন আর কোনো ঘটনা নেই, যেখানে কোনো ওষুধ এইভাবে তৈরি করা হয়েছে।’
এর মধ্যেই যে ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা আর কাটিয়ে উঠতে পারবে না এই ওষুধ।
ড. টিমোথি বিবিসিকে বলেন, ‘প্রথম বছরটা আমরা সত্যিই খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, রোগটির খুব আস্তে আস্তে বিস্তার হচ্ছে।’
এর আগে মিলা দিনে ১৫ থেকে ৩০ বার অচেতন হয়ে যেতো। কিন্তু ওষুধটি শুরু করার পর সেটি দিনে ০ থেকে ২০ বারে নেমে আসে, যা সাধারণত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়।
তার পরিবার জানিয়েছে, সে এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে এবং আগের চেয়ে ভালো থাকছে।
তবে দ্বিতীয় বছরের চিকিৎসায় লক্ষ্মণ দেখা দিতে শুরু করে যে, রোগটির আবার বিস্তার ঘটছে এবং মিলাকে ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা শুরু হয়।
ড. টিমোথি বলেন, ‘আমরা ভাবছিলাম, এটা যতটা হওয়ার কথা তার চেয়ে কম বাড়ছে এবং আশা করছিলাম যে, সেটা আবার স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’
তিনি বিশ্বাস করেন, এ ধরনের রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে যদি আরও আগে হস্তক্ষেপ করা যায়, বিশেষ করে যখন কোনো শিশুর বয়স তিন থেকে চার বছর, তাহলে ‘সত্যিই বড় সফলতা পাওয়া যেতে পারে’।
জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে সাত হাজারের বেশি বিরল রোগ রয়েছে, যার অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার কোনো পদ্ধতি চালু নেই।
সব বিরল রোগ নয়-এমনটি ব্যাটেন রোগের ক্ষেত্রেও মিলার মতো একই ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না।
কিন্তু ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ তৈরির আশা তৈরি হয়েছে, যা তৈরি হবে জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে, রোগটি কী কারণে তৈরি হচ্ছে আর তার জন্য ঠিক কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তা ড. জ্যানেট উডকক বলেন, ‘ব্যক্তিনির্ভর এসব ওষুধ, যাকে বলা হয় এন-অফ-ওয়ান, একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়, যা নতুন আলোচনা তৈরি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন মানুষের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করতে হলে কোনো ধরনের প্রমাণ প্রয়োজন?’
‘এমনকি দ্রুত বিস্তার ঘটছে এমন রোগের ক্ষেত্রেও, মারাত্মক অসুস্থতায়, গুরুতর জটিল রোগেও মৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ন্যূনতম নিশ্চয়তা কী?’ এমন প্রশ্ন তার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন