যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর বিরোধীতা সত্ত্বেও অবশেষে তুরস্কের হাতে এসে পৌছেছে রাশিয়ার তৈরি সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম চালান বুঝে পেয়েছে। রাজধানী আঙ্কারার কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে এসে পৌছেছে এর প্রথম চালান। এর ফলে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তুর্কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যন্ত্রপাতির প্রথম পর্ব আঙ্কারার পাশ্ববর্তী মুরটেড বিমান ঘাঁটিতে এসেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এর আরো কয়েকটি চালান এসে পৌছবে। তারপরই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি প্রস্তুত হয়ে যাবে ব্যবহারের জন্য।
ইস্তাম্বুল থেকে আলজাজিরার প্রতিনিধি জানিয়েছে, এ বছরের অক্টোবর মাস থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষ ব্যবস্থা পুরোদমে কাজ করতে শুরু করবে।
রাশিয়ার তৈরি এই সর্বাধুনিক অস্ত্রটি প্রথম দেশ হিসেবে হাতে পেল তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র গত দুই বছর ধরে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের এই চুক্তির ঘোর বিরোধীতা করে আসছে। কিন্তু তাতেও পিছু হটেনি রজব তাইয়েব এরদোগানের দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের কোন সদস্য দেশ রাশিয়ার এই সর্বাধুনিক অস্ত্র কিনবে সেটিও পছন্দ নয় পশ্চিমাদের। যে কারণে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়ার কাছ থেকে এই অস্ত্র কিনলে তুরস্কের ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। কিন্তু সেই হুমকি টলাতে পারেন তুর্কিদের।
এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কেন এত আলোচিত
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে যে অস্ত্রটি তার নাম এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। রাশিয়ার তৈরি এই সমরাস্ত্রটিকে বিবেচনা করা হয় ক্ষেপণাস্ত্র অঙ্গনের সর্বাধুনিক সংস্করণ হিসেবে। নতুন এই অস্ত্রটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে অনেক দেশ, যাদের মধ্যে রয়েছে এমন দেশ যারা আবার যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। যে কারণে ক্ষুব্ধ ওয়াশিংটন। এই অস্ত্রটিকে কেন্দ্র করে তাই নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সমীকরণ তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
রাশিয়া সমরাস্ত্র তৈরিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশ। তেলের পরেই দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়ের উৎস সমরাস্ত্র বিক্রি। নতুন এই এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার অস্ত্র শিল্পের আলোচিত একটি ‘পণ্য’। উদ্ভাবনের পরই আলোচনার জন্ম দিয়েছে বহুমুখী এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি।
রাশিয়ার এই অস্ত্রটি কিনতে ইতোমধ্যেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন, সৌদি আরব, ভারত, কাতারসহ বেশ কিছু দেশ। সবার আগে তুরস্ক এ বিষয়ে চুক্তিও করে ফেলেছে রাশিয়ার সাথে। এ নিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরোধীতার মুখোমুখী।
কিন্তু কী আছে এই এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়- যার কারণে এটি এতটা গুরুত্ব পাচ্ছে সবার কাছে? বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই অস্ত্রটির এত আলোচনার জন্ম দিয়েছে দুটি কারণে এক- এটি প্রযুক্তিগতভাবে সর্বাধুনিক, দুই- এটি অনেক দেশের দীর্ঘদিনের মিত্রতার মাঝখানে হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক সাইমন ওয়াজেমান বলেন, ‘এস-৪০০ হচ্ছে এখন পর্যন্ত সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, পশ্চিমারা এখন পর্যন্ত যা তৈরি করেছে তার চেয়ে অনেক অগ্রসর এটি। এটির রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা অন্যান্য সেন্সরের ক্ষমতা অনেক বেশি। এটির রাডার ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার ওপর নজরদারি করতে পারে। এটির ক্ষেপণাস্ত্রের সীমা ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এটি লক্ষবস্তু নির্ধারণেও অনেক নির্ভুল।’
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই অস্ত্রটি স্থাপন করা, প্রস্তুত করা ও ফায়ার করা যায়। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া যায় সহজেই।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সামরিক বিশ্লেষক কেভিন ব্রান্ড বলেন, ‘এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি হলো একের মধ্যে অনেক গুনাগুণ সমৃদ্ধ। এটি দিয়ে দূর পাল্লা, মাঝারি পাল্লার এমনিক স্বল্প পাল্লার রকেট ছোড়া যায়। এটি নির্ভর করবে ব্যবহারকারীর ইচ্ছের ওপর’।
এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি সড়ক পথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া যায়, যেমনটা চায় বেশির ভাগ দেশ’। সেই সাথে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই অস্ত্রটি হয়তো বিশ্বকে বিপজ্জনক কোন পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যেতে পারে। এর একটিই কারণ, মার্কিন মিত্ররাও এখন ঝুঁকছে রাশিয়ার এই অস্ত্রের দিকে। যেটি পছন্দ নয় ওয়াশিংটনের।
এস-৪০০ একই সময়ে ৩৬টি লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এমনকি একই সময়ে ৭২টি রকেট ছুড়তে সক্ষম। এ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় একটি যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ পোস্ট, তিনটি সমন্বয়কারী জ্যাম-প্রতিরোধী পর্যায়ক্রমিক অ্যারে রাডার, বিমানের লক্ষ্যমাত্রা শনাক্ত করা, আটটি বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কমপ্লেক্স (১২টি ট্রান্সপোর্টার-লঞ্চার, একটি বহু-কার্যকরী চার আলোকসজ্জা ও শনাক্তকরণ রাডার) যুক্ত রয়েছে। এছাড়া এটি একটি প্রযুক্তিগত সহায়তা ব্যবস্থা, একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহন যানবাহন ও একই সঙ্গে এটি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন