আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে যেসব প্রযুক্তি ও অ্যাপ সেগুলো যারা তৈরি করেছেন তাদের অনেকেই এখন নিজেদের সন্তানদেরকে এসব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।
সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করা এসব তরুণ উদ্ভাবকের অনেকেই বিশ্বের বৃহত্তম সব প্রযুক্তি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের অনেকে বিয়ে শাদি করে এখন নিজেরাও পিতামাতা হয়েছেন। খবর বিবিসি বাংলার
এদের মধ্যে কেউ কেউ এখন তাদের নিজেদের সন্তানরা যাতে এসব প্রযুক্তি ও অ্যাপ ব্যবহার করতে না পারেন সেবিষয়ে সচেষ্ট থাকেন। এবং এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাদের কোন রাখঢাক নেই।
অ্যাপলের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস ২০১১ সালে একবার স্বীকার করেছিলেন যে তিনি এবং তার স্ত্রী লরেন পাওয়েল মিলে বাড়িতে তাদের সন্তানদের এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্যে কিছু সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসও তার সন্তানরা কতোটুকু সময় স্ক্রিন ব্যবহার করতে পারবেন তার একটা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। পড়ার টেবিলে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন মোবাইল ফোনও।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ২০১৭ সালে তার নবজাতক অগাস্টের উদ্দেশ্যে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে তিনি তাকে ঘরের বাইরে গিয়ে খেলতে বলেছিলেন।
কিন্তু সিলিকন ভ্যালির এই প্রযুক্তি উদ্ভাবকরা অভিভাবক হওয়ার পর কেন তাদের নিজেদের সন্তানদেরকে স্ক্রিন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন?
প্রযুক্তি-মুক্ত শৈশব
সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়াতে একটি টেক কোম্পানির নির্বাহী পিয়ের লরেন্ট। সিলিকন ভ্যালিতে একটি জনপ্রিয় বেসরকারি স্কুল ওয়ালডর্ফ স্কুল অফ দ্যা পেনিনসুলারও বোর্ড পরিচালক তিনি। এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা কিশোর বয়সে পৌঁছানো না পর্যন্ত প্রযুক্তি ও অ্যাপ পরিহার করে চলে।
বেশি টিভি দেখলে স্মৃতিভ্রংশ হয়
লরেন্ট, যিনি এই স্কুলে তার তিন সন্তানকে পাঠান লেখাপড়া করতে, বিবিসিকে বলেছেন, সেখানে অভিভাবকদের তিন-চতুর্থাংশই কোন না কোনভাবে বিভিন্ন টেক কোম্পানিতে কাজ করছেন।
স্কুলের পক্ষ থেকেই তাদেরকে বলা হয়েছে সন্তানদের লেখাপড়ার ওপর এসব প্রযুক্তির কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেবিষয়ে নজর রাখার জন্যে।
তিনি বলেন, আপনি যখন ছোট্ট একটা শিশু তখন তো এক টুকরো কাঁচ থেকে আপনার শেখার কিছু নেই। আপনাকে আসলে সবগুলো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে হবে। আপনার যা কিছু আছে তার সবকিছু দিয়েই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে হবে।
অসঙ্গতি
সিলিকন ভ্যালির কর্মকর্তাদের এই পরষ্পর-বিরোধিতার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ওয়ালডর্ফ স্কুলটি আলোচনায় উঠে আসে।
সারা বিশ্বে প্রযুক্তির কেন্দ্র বলে পরিচিত এই সিলিকন ভ্যালির স্কুলটি এমন এক শিক্ষার উপর জোর দিচ্ছে যেখানে শিশুরা সর্বতোভাবে লাভবান হবে।
এই স্কুলের পাঠ্যসূচিতে জোর দেওয়া হয়েছে একুশ শতকের দক্ষতার উপর যার মধ্যে রয়েছে নিজের জীবনের শৃঙ্খলা, স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা করা, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করা এবং শৈল্পিকভাবে সবকিছু প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করা।
পিয়ের লরেন্ট বলেন, এসব মানবিক ক্ষমতা স্ক্রিনের সামনে বসে অর্জন করা যায় না। বাস্তব জীবনে বিভিন্ন কাজ করার মাধ্যমে এবং নিজে হাতে কলমে সেসব করার মাধ্যমেই এসব গুণাবলী অর্জন করা সম্ভব।
ভিন্ন মত
সিলিকন ভ্যালির এক দল অভিভাবক যখন এরকমটা ভাবছেন তখন আরেক দল অভিভাবক আছেন যারা মনে করেন একুশ শতকে শিক্ষার একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ এই প্রযুক্তি।
শ্রেণি কক্ষে ভাল করার পাশাপাশি বাইরের জীবনে সাফল্যের জন্যেও এই প্রযুক্তি জরুরি বলে তারা মনে করেন।
কমন সেন্স মিডিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যা পরিবারগুলোকে ডিজিটাল বিনোদন এবং প্রযুক্তির বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে, তার একজন ঊর্ধ্বতন পরিচালক মার্ভ লাপুস প্রায় এক দশক ধরে এনিয়ে কাজ করছেন।
তিনি বলছেন, হ্যাঁ, প্রযুক্তি মনোযোগ নষ্ট করতে পারে, কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়াবো? কারণ প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে শিশুদের কাছে অনেক সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি বাস্তব পৃথিবীর জন্যে তাদেরকে প্রস্তুতও করতে হবে। তখন তো এসব উপকরণ (প্রযুক্তি ও অ্যাপ) ব্যবহারের প্রয়োজন হবে।
ভারসাম্য খুঁজে বের করা
শিশুদেরকে স্ক্রিনের জন্যে কতোটুকু সময় দেওয়া দরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা সেই সময় আরো কমিয়ে দিয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের একা একা টেলিভিশনসহ কোন স্ক্রিনই দেখতে দেওয়া ঠিক নয়। আর দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের জন্যে এই সময়সীমা দৈনিক এক ঘণ্টা কিম্বা তারচেয়েও কম।
কিন্তু লাপুস বলছে, সব স্ক্রিনকে এক কাতারে বিবেচনা করা উচিত নয়। তার দুটো সন্তান। একটি চয় আর অন্যটি আট বছরের। তাদের স্ক্রিন ব্যবহারের বিষয়েও কথা বলেন তিনি।
আগে তারা যতোটা স্ক্রিনে থাকতো এখন তাদের ততোটা থাকা ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাকে রাতের খাবার তৈরি করতে হয়। কিন্তু সিসাম স্ট্রিট দেখাও তাদের বিনোদনের বড় একটি উপায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন