এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ইসলাম সম্পর্কে গণমাধ্যমের সংবাদসমূহের অধিকাংশই নেতিবাচক। প্রায়শই এসব গণমাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে একটি সহিংস ধর্ম হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় এবং মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধান করাকে তাদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম ধর্ম তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম এবং বিশ্বে দ্বিতীয় কিন্তু দেশটির অধিকাংশ নাগরিকের ব্যক্তিগতভাবে কোনো মুসলিমের সাথে সম্পর্ক নেই।
২০১৭ সালে করা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩.৪৫ মিলিয়ন মুসলিমের বসবাস।
বার্তা সংস্থা BuzzFeed News এর প্রতিবেদক হান্নাহ আলাম Journalist’s Resource নামের একটি সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যম সমূহের জন্য ইসলাম সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশের জন্য ৬টি পরামর্শ দিয়েছেন-
১। মুসলিমদের সম্পর্কে আলোচনা করার সময় মসজিদের বাহিরের দিকে তাকান
Pew Research Center এর করা এক গবেষণায় দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ জন মুসলিমের ৪ জন প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার মসজিদে যান। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের ৩০ শতাংশ পুরো একটি বছরে খুব কম সময়ই মসজিদে কাটান। আর দেশটির ২৫ শতাংশ মুসলিম কখনোই মসজিদে যান না।
হান্নাহ আলাম সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে করে তারা মুসলিমদের নিয়ে কথা বলার সময় মসজিদকে একমাত্র সূত্র হিসেবে ব্যবহার না করেন। তিনি প্রতিবেদকদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে তারা মুসলিম ডাক্তার এবং মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিকটে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে আরো জানার চেষ্টা করেন।
২। প্রতিবেদনে আরবি শব্দের ব্যবহারের পূর্বে তা কেন ব্যবহার করছেন তা পুনরায় চিন্তা করুন।
সাংবাদিকগণ যখন ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষদের জন্য ইসলাম সম্পর্কিত কোনো সংবাদ তৈরি করেন তখন তারা তাতে অনেক আরবি শব্দের ব্যবহার করেন, যেমন- আল্লাহ, হিজাব, শরিয়া ইত্যাদি। আল্লাহ শব্দটি একটি আরবি শব্দ এবং এর ইংরেজি অর্থ God অন্যদিকে হিজাব শব্দটির অর্থ মাথা ঢেকে রাখে এমন কাপড়। কিন্তু বৃহৎ অর্থে হিজাব শব্দটির অর্থ শালীন পোশাক।
হান্নাহ আলাম বলেন, যখন আপনি ইসলাম সম্পর্কে কোনো বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতে চাইবেন তখন আপনি পুনরায় এর কাছাকাছি কোনো শব্দ আছে কিনা তা খুঁজে দেখুন।
একইভাবে তিনি প্রতিবেদকদের কাছে জানতে চান যে, কেন তারা ইংরেজি শব্দ God এর একটি আরবি শব্দ খুঁজতে চান। তিনি বলেন, আল্লাহ শব্দটি বিশেষভাবে প্রকাশ করা যায় যেমন ‘ইনশাল্লাহ’ যার অর্থ ‘আল্লাহ চাইলে’।
৩। অতিরিক্ত সার্বজনীন করা হতে বিরত থাকুন
যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমগণ অতি উচ্চমানের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। সেখানে মুসলিমদের মধ্যে ঐতিহ্য এবং ধর্ম চর্চায় বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়।
এদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিমগণ যাদের অবস্থান দেশটির মুসলিমদের মধ্যে পঞ্চম। তাদের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ব্যাপক বৈচিত্র্য। Pew Research Center এর করা এক গবেষণায় দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের মধ্যে ৫১ শতাংশ মুসলিম যাদের পরিবারের সূত্র অন্তত তিনটি প্রজন্ম ধরে দেশটিতে বসবাস করছে তারা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ।
Council on American-Islamic Relations এর পরিচালক Journalist’s Resource কে বলেন, ১৯ শতক থেকে ২০ শতকে মুসলিম অভিবাসীদের প্রথম দল যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। তাদের মধ্যে আরব, তুর্ক, বলকান, ইয়েমেন এবং সিরিয়া থেকে আসা মুসলিমরা ছিল।
Immigration and Naturalization Act of 1965 এর পরে মুসলিমরা বিশ্বের সমগ্র স্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে থাকে। হান্নাহ আলাম বলেন, ‘মুসলিম কমিউনিটি নামক শব্দের ব্যাবহার এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন, কারণ এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ৩.৫ মিলিয়ন মুসলিম এখানে এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে এবং তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন।’
৪। মুসলিমদের ব্যক্তিগত অর্জন সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরীর পূর্বে সতর্ক থাকুন।
হান্নাহ আলাম সাংবাদিকদের জানাতে চান যে, যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম হওয়া স্বত্বেও সংবাদ মাধ্যমে আসার যোগ্য না হন তবে কেন তার সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করতে হবে?
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রথম মুসলিম নারীদের সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়া আসলেই কাজের কারণ তারা একটি বৃহৎ জনসমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সকল মুসলিমদের জন্য গর্বের ব্যক্তি। কোনো মুসলিম নারী বাস্কেটবল খেলোয়াড় বা ফুটবল খেলোয়াড় শুধুমাত্র তাদের হিজাবের জন্য সংবাদের কারণ হতে পারেন না।
৫। বিভিন্ন ধরণের সংবাদে মুসলিমদের সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরীতে কাজ করুন।
হান্নাহ আলামের মতে সাংবাদিকদের উচিত মুসলিমদের সম্পর্কে আরো বেশী সংবাদ প্রকাশ করা যেগুলো ইসলামের সাথে জড়িত নয়। মুসলিমদের সংবাদ প্রতিবেদনে এমন ভাবে তুলে ধরা উচিত যাতে তাদের ধর্ম পরিচয় বড় হয়ে না দেখা দেয়।
তিনি বলেন, ‘আর এর মাধ্যমেই পাঠক বিভিন্ন পেশার বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে পারবে। উদাহরণ সরূপ- একজন ডাক্তারকে মুসলিম ডাক্তার বা একজন ডিজাইনারকে মুসলিম ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে ডাকা যেতে পারে।’
প্রসঙ্গত, The Institute for Social Policy and Understanding এর করা ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ১১ শতাংশ প্রকৌশলী হচ্ছেন মুসলিম।
৬। আপনার আলোকচিত্র ধারণের সময় বৈচিত্র্য তুলে আনুন
যেখানে অনেক সংবাদ মাধ্যমের নিকট যথাযথ আলোকচিত্রের অভাব রয়েছে সেখানে প্রথাগত ধারার বাহিরে এসে এমন ভাবে আলোকচিত্র ধারণ করা উচিত যাতে করে মুসলিমদের সামনে আনা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমি কদাচিৎ এমন আলোকচিত্র দেখতে পাই যেখানে আমি আমার ভাইদের যারা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনা হিসেবে কর্মরত তাদের তুলে ধরা হয়।’
পারতপক্ষে, এমন মুসলিম তরুণদের যারা অলাভজনক কাজে জড়িত তাদের তুলে আনার চাইতে এমন মুসলিমদের তুলে আনা প্রয়োজন যাদের বিচরণ সিলিকন ভ্যালিতে বা সিরিয়ার উদ্বাস্তু কেন্দ্র সমূহে।
সূত্র: দ্যা কনভারসেশন ইউএস নামক সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক কল্পনা জেইনের কলাম থেকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন