সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক আরব সরকারগুলো তাদের সমালোচকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছে যে, আরব রাজত্বের সমালোচনা করে কেউ এতোটা সহজে পার পেয়ে যাবে না।
২০১১ সালের মত আরেকটি আরব বসন্তের মাধ্যমে আরব অঞ্চলে একটি গণতান্ত্রিক শাসনের স্বপ্ন দেখা বিরোধী রাজনৈতিক এবং সাংবাদিকদের কাছে খাসোগি হত্যাকাণ্ড একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন থেকে মিশরের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী ৭ বছর পূর্বে শুরু হওয়া আরব বসন্তের অবসানের ইঙ্গিত দেয়ার জন্য স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করেছেন।
মিশর এবং বাহরাইন সরকারের সমালোচক হাজার হাজার বিরোধী মতাবলম্বীদের গণ গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এসব দেশের গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো শত শত সমালোচককে আটক করে রাখা হয়েছে।
মিশর সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেয়া একটি গণমাধ্যম ওয়েব সাইটের প্রধান সম্পাদক খালেদ আল-বালশেই এ সম্পর্কে বলেন, ‘খাসোগি হত্যাকাণ্ডটি একটি ভয়ঙ্কর বিষয়। এর মাধ্যমে স্বৈর শাসকেরা দেখাতে চেয়েছেন যে, বিরোধী মত দমনে তারা কত দুর পর্যন্ত যেতে পারেন।’
‘এর পূর্বে জনগণ মনে করতো যে, দমন পীড়নের অবশ্যই একটি মাত্রা রয়েছে’- খালেদ আল-বালশেই খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিশরীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমে তারা এই ঘটনাটিকে এড়িয়ে চলেছে কিন্তু পরবর্তীতে নিহত ব্যক্তির পক্ষ অবলম্বন না করে তারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বাঁচাতে উদ্যোগী হয়ে উঠে।’
সাংবাদিক খাসোগি সৌদি কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের সাথে হাতাহাতি করতে গিয়ে মারা যান সৌদি সরকারের এমন ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করে বলেছিলেন- ‘এ পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে বাজেভাবে ধামাচাপা দেয়ার ঘটনা।’
যুক্তরাজ্যের লন্ডন ভিত্তিক বাহরাইন ইন্সটিটিউট ফর রাইট’স এন্ড ডেমোক্রেসির পরিচালক বাহরাইনের নাগরিক সাইয়্যেদ আলওয়াদাই বলেন, ‘বর্তমান দমন পীড়ন আমাদেরকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়।’
‘এর একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অতোটা উদ্বিগ্ন নন আর অন্যটি হচ্ছে ব্রিটিশ ব্রেক্সিট এজেন্ডা।’
যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক আরব দেশসমূহের সাথে কৃত সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক চুক্তিসমূহের স্বার্থ রক্ষার দিকটি দেশটির সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সাইয়্যেদ আলওয়াদাই গ্রেপ্তার হন এবং ছয় মাস কারা অন্তরীণ থাকার পর মুক্তি পান। তিনি ২০১২ সালে বাহরাইন থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্য চলে আসেন।
বাহরাইন সরকারের সমালোচনা করার কারণে বাহরাইন সরকার তার পরিবারে সদস্যদের অনেককেই আটক করে রেখেছে, যাদের মধ্যে তার শাশুড়ি এখনো কারা অভ্যন্তরে আছেন-সাইয়্যেদ আলওয়াদাই এমনটি জানান।
তিনি বলেন, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সাংবাদিক খাসোগি হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা সত্বেও সৌদি আরবকে পশ্চিমা সরকার প্রধানগণ যেমনটি দেখতে চায় ঠিক সেরকম সৌদি আরব বিনির্মাণের অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে ক্রাউন প্রিন্স সালমানকে এমন কুকর্ম কারার লাইসেন্স দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যদি কেই বলেন যে, মোহাম্মদ বিন সালমান নারীদেরকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে বিজ্ঞের মত কাজ করেছেন, কিন্তু তিনি এসব করেছেন কারণ পশ্চিমারা এসবই দেখতে চায়।’
সুন্নি অধ্যুষিত বাহরাইনের সরকার সৌদি আরবের সমর্থনে গত বেশ কয়েক বছর যাবত দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতিকে খুবই নিম্নগামী পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। বাহরাইনের শিয়া জনগণের প্রতি দমন পীড়ন অব্যাহত রয়েছে যা সবচেয়ে খারাপ দিকে পৌঁছিয়েছিল ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময়।
দেশটিতে অন্তত ৩,০০০ রাজনীতিবিদ আটক রয়েছেন এবং শত শত নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাহরাইন পশ্চিমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের ভূমিকা পালন করছে।
একই সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত গাল্ফ রাষ্ট্র সমূহের ব্যবসার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে কাজ করছে। দেশটিতে ২০১১ সালের পর থেকে রাজনীতি নিয়ে যে কোনো ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করা হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন সাইবার অপরাধ দমন আইনের আওতায় সেখানকার বেশ কিছু ইসলাম পন্থী ব্যক্তি এবং অনেক মানবাধিকার কর্মীকে আটক করা হয়েছে। চলতি বছরে স্যোশাল মিডিয়ায় ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের মান হানি ঘটানোর’ দায়ে মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মানসুরকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ম্যাথিউ হেডেজ নামক যুক্তরাজ্যের একজন শিক্ষার্থীকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। এর পূর্বে তাকে অন্তত পাঁচ মাস নির্জন কারাবাসে কাটাতে হয়।
মিশরে নামক দেশটির স্বৈর শাসক সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থনে দেশটির বিরোধী মত দমনে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে। দেশটিতে ২০১৩ সালে নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে উৎখাত করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
সাবেক সেনা প্রধান এবং মিশরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল-সিসি’র প্রশাসন মুসলিম ব্রাদারহুড়ের হাজার হাজার নেতা কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।
চলতি মাসে আবদেল খালেক ফারুক নামে একজন লেখককে আটক করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ‘Is Egypt Really a Poor Country’ নামক বইতে সিসি’র অর্থনৈতিক কৌশলের সমালোচনা করেছেন।
তবে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সামনে আসায় উপরোল্লেখিত বিষয় সমূহের কিছুটা উন্নতি হবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করা সৌদি নাগরিক সাদ আল-ফাগিহ নামে একজন বলেন, বর্তমান সঙ্কট বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আরব রাজত্বের সমালোচকদের প্রতি একটি হুমকি স্বরূপ।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে সৌদিতে হয়তো দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে, যেখানে হয় সৌদি নাগরিকেরা পুনরায় তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবেন অথবা বিরোধী মত সমূহকে অন্তত কিছুটা সমালোচনার ক্ষেত্র দেয়া হবে।’
সূত্রঃ ফিনান্সিয়াল টাইমস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন