সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থিত সৌদি আরবের কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগি খুন হওয়ার ঘটনায় পুরো বিশ্বের সন্দেহের তীর সৌদি সরকারের দিকে বিশেষত সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে।
সাংবাদিক খাসোগি ছিলেন একজন সৌদি নাগরিক যিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। সৌদি সরকারের কট্টর সমালোচক খাসোগি আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখার মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
চলতি মাসের ২ তারিখে ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশকালীন তাকে সর্বশেষ জীবিত দেখা গিয়েছিল। চলতি মাসের ১৯ তারিখে সৌদি কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সৌদি কনস্যুলেটের অভ্যন্তরে খাসোগি নিহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। সৌদি সরকারের এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে এ কথা আবারো প্রমাণিত হল যে, সৌদি রাজতন্ত্রের ধারক-বাহকেরা কিভাবে মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে এবং তারা বিরোধী মত দমনে কতটা কঠোর।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সৌদি আরব সম্পর্কে যেখানেই আলোচনা হোক না কেন, ইসলাম এর পাশাপাশি থাকবেই। সৌদি সরকার যে পদক্ষেপই নেয় না কেন স্বাভাবিকভাবেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি সরকারের নেয়া পদক্ষেপের সাথে ইসলামের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
খাসোগি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এ কথা আবারো প্রমাণিত হলো। খাসোগি একজন অজানা সাংবাদিক ছিলেন আর তিনি সৌদি রাজত্বের সমালোচনা করার মাধ্যমে পাদ-প্রদীপের আলোয় আসেন।
খাসোগি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পশ্চিমা মহলে এই কথা ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে, শুধুমাত্র সৌদি রাজতন্ত্র নয় বরং ‘ইসলাম ধর্ম নিজেই যে কোনো সমালোচনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে’।
ধর্মের গায়ে এ ধরনের কম্বল পরিয়ে দেয়ার কর্মে সৌদি সরকারের বর্তমান কার্যক্রমের ফলে তাতে আরো বেশি রং মেশানো হচ্ছ এবং একই সাথে সৌদি সরকারের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলামকে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে।
তথাপি, পশ্চিমা বিশ্বসহ প্রায় সকল দেশের মানুষ এধরনের একটি গতানুগতিক ধারণা পোষণ করেন যে, সৌদি আরব ইসলামের প্রাথমিক ভিত্তিগুলোর ধারক এবং বাহক, আর দেশটি সকল ক্ষেত্রেই ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাস্তবিকভাবে সৌদি আরব ইসলামের প্রতিনিধি নয়। যদিও সৌদি আরব নিজেকে ‘ইসলামে কেন্দ্র বিন্দু’ হিসেবে প্রমাণ করতে চায় কিন্তু ভেতরগতভাবে দেশটি মোহাম্মদ বিন সালমানের মত কিছু একরোখা ব্যক্তি দ্বারা ক্ষমতার কেন্দ্রকে সুরক্ষিত করার জন্য পরিচালিত হচ্ছে।
পবিত্র মদিনা এবং মক্কা নগরীর রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশটি ইসলামের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নিজের বৈধতা জানান দিয়ে থাকে।
পেট্রো-ডলারের সাহায্যে একের পর এক স্বৈরশাসক দ্বারা পরিচালিত সৌদি সরকার বিশ্ব ব্যাপী ওহাবিজম মতবাদ ছড়িয়ে দিয়ে একথা প্রচার করে যে, সৌদি আরব এবং ইসলাম একে অপরের পরিপূরক।
যদিও প্রাচ্যের দেশসমূহ, মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম দেশসমূহের নিকট সৌদি আরব হচ্ছে ইসলামের কেন্দ্র বিন্দু কিন্তু দেশটির লালনকৃত ওহাবি চিন্তাধারা ইসলামের অন্যান্য ঐতিহ্যগুলোর সাথে একেবারেই খাপ খায় না। ওহাবিজম ভিন্ন মতকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু এই দেশটি ইসলামের প্রতিনিধি নয়, পূর্বেও ছিল না এবং বিশেষত বর্তমানেও নয়। সৌদি আরব শুধুমাত্র একটি জাতি যারা ওহাবিজম মতবাদ ছড়িয়ে দিতে চায়। তাদের এধরনের চর্চা শুধুমাত্র দেশটির ৩২ মিলিয়ন নাগরিক পালন করে থাকে।
ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়া সৌদি আরবের চাইতেও বেশি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এমনকি নাইজেরিয়ার মুসলিম জনসংখ্যা সৌদি আরবের চাইতে ২.৫ শতাংশ বেশি। বিশ্বের মুসলিমরা এখন বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা যেভাবে ইসলামকে দেখে তার সাথে সৌদি আরবের কোনো মিল নেই এবং এধরনের জনমত যুক্তরাষ্ট্রে আরো বেশি করে দেখা যাচ্ছে।
সৌদি আরব ইসলামের সাথে রয়েছে এমন জনপ্রিয় মতকে বুঝতে হলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞের মতামতকে বুঝতে হবে। সৌদি আরব মূলত ইসলামের নামে ওহাবিজম লালন করে চলেছে।
প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে সৌদি আরব শুধুমাত্র ওহাবিজম প্রচার করতে চায়। কিন্তু বিষদ তদন্ত করলে দেখা যাবে যে, দেশটি তার অভ্যন্তরে এবং বিশ্বব্যাপী যে কোনো মূল্যেই একজন ক্রাউন প্রিন্স এবং তার ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হতে চায়।
খাসোগি যিনি সততা এবং সাহসের সাথে সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য এমন একটি দেশে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যে দেশটি বহু দিক থেকেই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছে। আর সৌদি আরব হচ্ছে সেই দেশ যেটি বিশ্বের অন্য সকল দেশ থেকে বিপরীত মুখি বসবাসের নজির রেখে চলেছে।
খাসোগি একই সাথে তার ধর্ম বিশ্বাস এবং তার দেশকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন। তা তার কাজ এবং সৌদি সরকারের অনিয়ম বিশেষত বর্তমান স্ট্রংম্যান মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়।
খাসোগির সাহসী সাংবাদিকতা ইসলামের অনুপ্রেরণামূলক দিকটিই তুলে ধরে এবং একই সাথে পর্দার আড়ালে সৌদি সরকারের অবিচারগুলোকে সামনে নিয়ে আসে।
প্রথমত, একজন মেধাবী সাংবাদিক হিসেবে তিনি সৌদি সরকারের অস্বীকার-কৃত স্বাধীন সাংবাদিকতার উদাহরণ তৈরি করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, সৌদি পর্দার অন্তরাল থেকে ইসলামকে একটি বৈশ্বিক ধর্মে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।
সূত্রঃ আল-জারিরায় প্রকাশিত আইনের অধ্যাপক খালেদ এ বেইদুন নামে বিশেষজ্ঞের কলাম থেকে যিনি ‘American Islamophobia: Understanding the Roots and Rise of Fear’ নামক বই লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন