বিশ্বের প্রথম সারির পাঁচটি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বহির্বিশ্বে চীনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদান বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট চারটি দেশের সাত কর্মকর্তা।
এ বছরের শুরু থেকে সমমনা দেশগুলো এভাবে তথ্য শেয়ার করছে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ফাইভ আইজ (Five Eyes) নামে পরিচিত জোটের সদস্য দেশগুলো হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।
বিভিন্ন স্থানে চীনের বিনিয়োগ ও প্রভাব রুখে দিতে এদের সঙ্গে জার্মানি ও জাপানেরও যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদেশি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের পরিধি বিস্তৃত করছে ফাইভ আইজ।
কয়েকজন জানান, চীন তাদের প্রধান লক্ষ্য হলেও রাশিয়ার বিষয়েও তারা জোরালো আলোচনা করেছেন।
‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের সপ্রভ উপস্থিতির মোকাবেলা কীভাবে করা যেতে পারে, সেটা নিয়েই সহযোগী সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা হয় এবং এটা আরো জোরদার হচ্ছে,’ রয়টার্সকে জানান যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা।
‘বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এসব আলোচনা শুরু হলেও, এখন এটা সর্বোত্তম কর্মপন্থা নির্ধারণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় রুপ নিয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
তবে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সরকার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন, ক্যানবেরা ও অন্যান্য দেশের রাজধানীর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে চীন। কিন্তু, ভিনদেশের সরকারকে প্রভাবিত করা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করার কথা অস্বীকার করেছে এশিয়ার এই পরাশক্তি।
আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি একাই চীনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। কিন্তু, ফাইভ আইজ তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার খবরে বোঝা যাচ্ছে, বেইজিংকে রুখে দিতে তার প্রশাসনের সদস্যরা আড়ালে থেকে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, বলা হয় রয়টার্সের প্রতিবেদনে।
ট্রাম্পের ‘শ্রেষ্ঠ আমেরিকা’ নীতির কারণে চীন ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টিতে উৎসাহিত করতে চাইছিল। কিন্তু, ফাইভ আইজ জোট বিস্তৃত করার খবর থেকে এটাও মনে হচ্ছে যে, চীনের এই আশা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
রয়টার্সকে বিভিন্ন কর্মকর্তারা জানান, তাদের মধ্যকার বেশিরভাগ আলোচনাই ‘বিভিন্ন মাধ্যমের অগোচরে’ হয়েছে। এসব কথোপকথনের বেশিরভাগই ছিল দ্বিপাক্ষিক। দুটি সূত্র বলছে, ফ্রান্সও এসব আলোচনায় ছিল। তবে তারা নিয়মিত এবং খুব বিস্তৃতভাবে সম্পৃক্ত ছিল না।
সোভিয়েত প্রভাবের মোকাবেলা করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা করা হয় ফাইভ আইজ। এতে জার্মানি ও জাপানকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে কেউ কিছু বলেননি।
কিন্তু, আগস্টে ফাইভ আইজের একটি বৈঠকের পর দেয়া বিবৃতিতে এই দুটি দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত কার্যক্রমের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, জোটটি ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ’ ব্যবহার করবে এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করবে।
সমন্বিত পদক্ষেপের পাশাপাশি ইতোমধ্যেই, স্পর্শকাতর প্রযুক্তিতে চীনের বিনিয়োগ কমিয়ে আনাসহ শি জিনপিংয়ের বিভিন্ন উদ্যোগকে প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নিয়েছে দেশগুলো।
চীনের প্রভাবের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার সরকার গত বছরের ডিসেম্বরে একাধিক নতুন আইন পাস করে। বিদেশের তদবির এবং রাজনৈতিক অনুদান কমিয়ে আনতে ষড়যন্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞাকে আরো বিস্তৃত করা হয় এসব আইনের আওতায়।
যুক্তরাষ্ট্রও এফআইআরআরএমএ হিসেবে পরিচিত একটি আইন পাস করেছে, যার মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে নির্দিষ্ট কিছু বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
জার্মানি গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে নতুন নিয়ম চালু করার পরও চীন সেখানে আরো নতুন নতুন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর জার্মানি বুঝতে পারে নতুন প্রবর্তিত নিয়ম যথেষ্ট নয় এবং সেখানে বিনিয়োগের বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য দেশটি আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে।
গত বছর বার্লিন দেশটির অভ্যন্তরে চীনের কার্যক্রমের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য নীরবে তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অভিযান শুরু করেছে। সরকারি সূত্র জানিয়েছে,,এই বিশ্লেষণ প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে এবং এর ফলাফল অনুযায়ী নতুন নীতিমালা চালু করা হতে পারে।
দুই বছর আগে চীনকে এক্সিট্রন নামের একটি সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয় জার্মানি। চীন এক্সিট্রনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মাসখানেক পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা নিরাপত্তাজনিত কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, জার্মানি বুঝতে পারে তারা ওই বিষয়গুলো খেয়াল করেনি। তখন জার্মানি চীনকে দেয়া অনুমোদন বাতিল করে।
মার্কিন কর্মকর্তারা এই ঘটনার পর মন্তব্য করেন, এক্সিট্রনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা বানচাল করে দেয়ার পর তথ্য আদান-প্রদানের গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয়েছে।
রয়টার্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ‘বেশ কিছু আলোচনা’ হয়েছে যেখানে, ওয়াশিংটন এই সমন্বিত কার্যক্রমে বিনিয়োগের নেতৃত্ব দেবে এবং অস্ট্রেলিয়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কূটনীতিক, গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সরকারপ্রধানরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানান তারা।
‘আমরা একটা নতুন পৃথিবীতে বাস করছি,’ বলেন ফাইভ আইজের এক কর্মকর্তা, যিনি গত এক বছরে বহির্বিশ্বে চীনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন রাজধানী ঘুরে বেরিয়েছেন।
‘একনায়কতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত দেশগুলো থেকে হঠাৎ চমক আসায় সমন্বিত কার্যক্রম ও গোপন তথ্য আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে,’ যোগ করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন