জেন রিডার: আমি রাত ৪:৩৫ মিনিটের সময় গোসল সেরে নিই। এতো রাতে গোসল করার সময় আমার মনে হয়েছিল আমি যেন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি, কিন্তু পরবর্তীতে আমি নিজেকে বোঝাই যে, আমি সঠিক কাজটিই করতে চলেছি।
আমরা যে হোটেলটিতে উঠেছিলাম সেখানে মৃদু বাতাস বয়ে চলেছিল। আমার স্বামী ব্রায়ান তার হাত দুটো মুখে ধরে রেখেছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, হাসপাতাল থেকে টেলিফোন আসলো কিনা?
আমার স্বামী টেলিভিশনে একটি খবর দেখছিল এবং তিনি আমাকে টেলিভিশনের দিকে তাকাতে বলেছিলেন।
‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোরা এর মুভি থিয়েটারে ব্যাপক গুলিবর্ষণের ফলে ১২ জন নিহত হয়েছে।’-টিভি তে এমনটি প্রচার হচ্ছিল।
এই মুভি থিয়েটারটি আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম (ডেনভার হোটেল) সেখান থেকে ১০ মাইল দূরে। ডেনভার হোটেলের পাশেই হাসপাতালটি অবস্থিত যেখানে এর পর দিন ব্রায়ানকে আমার একটি কিডনি দান করার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল। আমরা যতটা সম্ভব ইতিবাচক থেকেছিলাম।
ব্যাপক গুলি বর্ষণের ঘটনায় আমরা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। সাথে সাথে আমরা সেসব মানুষদের জন্য প্রার্থনা করলাম যারা শুধুমাত্র ব্যাটম্যান মুভি দেখতে এসে তাদের প্রাণ হারাল।
আমি সাইরাকুস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময় ব্রায়ানের প্রেমে পড়েছিলাম। আমরা একসাথে ১৫ বছর কাটিয়েছি। আমরা এই দারুণ সময়গুলো পাহাড়ে চড়ে, ভ্রমণ কারে, হাসা হাসি করে এবং নাচগান করার মধ্যমে কাটিয়েছি।
আমরা হাওয়াইতে ভ্রমণকারীদের জন্য একটি দিকনির্দেশনামূলক একটি বই রচনার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেসময় হাওয়াই দ্বীপের সবচাইতে বড় একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ আমাদেরকে একটি খারাপ সংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ব্রায়ানের IgA nephropathy নামক (ডায়াবেটিকস রোগের চূড়ান্ত ফল হিসেবে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া)একটি রোগ হয়েছে।
সেসময় ব্রায়ানের বয়স মাত্র ৩০ বছর চলছিল এবং যেকোনো সময়েই ব্রায়ানের একটি কিডনি পাল্টে ফেলতে হতে পারে।
এক সময় ডা. আমাদেরকে জানান, ‘ব্রায়ানের অপর কিডনিটিকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদেরকে একজন কিডনি দাতা খুঁজে বের করতে হবে এবং এটি করতে হবে ডায়ালাইসিসের পূর্বেই।’
আমি তাৎক্ষণিকভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমিই ব্রায়ানকে একটি কিডনি দান করবো। ব্রায়ানের রক্তের গ্রুপের সাথে আমার রক্তের গ্রুপের অমিল ছিলো। সে কারণে আমি ভেবেছিলাম কিডনি দান করার ব্যাপারটা অনেক জটিল হতে পারে। তবে আশার বিষয় ছিলো, আমি শিগগিরই জেনেছিলাম যেহেতু আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’ তাই আমি একজন ইউনিভার্সাল দাতা। সুতরাং কিছু ডাক্তারি পরীক্ষার পরে আমি কিডনি দানের জন্য উপযুক্ত হবো।
যখন সে সময় এসেছিল তা আমার কাছে অনেকটাই সহজ মনে হয়েছিল। অবশ্য আমাকে কিছু মানুষিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কিডনি দানের জন্য আমি কোনোরূপ চাপের সম্মুখীন হয়েছিলাম কিনা? আমাকে পুরো দিনই চেক আপ করা হয়েছিল। রক্ত পরীক্ষা, ইকেজি পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে,সিটি স্ক্যান ইত্যাদি করানো হয়েছিলো। তবে এসকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাইতেও সবচাইতে খারাপ বিষয় ছিল জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটা।
মহিলা ডাক্তারটি আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি সত্যিই আপনার স্বামীকে কিডনি দান করতে চান? কারণ যদি আপনি না বলেন, তখন আমরা বলে দিবো যে, আপনি উপযুক্ত নন।’
আমি তার স্থির দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি দান করবো। আমি সত্যিই আমার স্বামীকে আমার কিডনি দান করবো।’
তিনি তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন এবং আমার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। আমি তখন ভয়ে ছিলাম এই ভেবে যে, আমি কি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি?
‘যখন আপনি নিজেকে একজন কিডনি দাতা হিসেবে ভাবেন,তখন কিসে আপনাকে সবচাইতে ভীতিগ্রস্ত করে?’
প্রতি উত্তরে আমি জোর দিয়ে আমার পূর্বের দেয়া বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলাম।
তিনি তার দৃঢ়তা ভেঙ্গে হাসতে শুরু করে দিলেন এবং বললেন আমি পূর্বেই এ বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলাম।
‘আপনি অবশ্যই কিডনি দানের জন্য উপযুক্ত।’ –তিনি আমাকে জানালেন, ‘আমি আমার দলকে এ কথা জানাচ্ছি।’
আমি তৈরি এবং এটি কোনো ব্যাপারই ছিল না। আপনি তখনই সবচাইতে বেশি অসহায় বোধ করবেন যখন আপনার ভালোবাসার মানুষটি ভীতিকর রোগে ভুগে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় যখন আমার একজন বন্ধু ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল, যখন আমার বাবার একটি বড় অপারেশন করা হয়েছিল, যখন আমার দাদী মারা গিয়েছিলেন, যখন আমার ফুফুর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল- তখন আমার এরকম অনুভূতি হয়েছিলো।
আপনি এসব সময় নৈতিক সমর্থন দিতে পারবেন কিন্তু আপনি এর ফলাফলকে রুখে দিতে পারবেন না। আমি সবসময় জাদু শিখতে চাইতাম যাতে এসব কিছু দূর করা যায়। অবশেষে ভাগ্যগুণে আমি তা শিখে গিয়েছি।
যখন আমাকে জেনেছিলাম আমি ব্রায়ানকে কিডনি দানের উপযুক্ত তখন আমি আনন্দে কেঁদে দিয়েছিলাম।
এটি কি এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার মত ব্যাপার যা আপনাকে ভয় পাইয়ে দেয় না? একদা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন বীরত্ব হচ্ছে, ‘ভয় মুক্ত থাকা নয়, বরং ভয়কে জয় করা।’ আমি কিডনি দান করতে ভয় পাইনি, তবে আমার পরিবারে অনেক সদস্য এবং আমার অনেক বন্ধুরা আমার এই সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
তারা আমাকে বলতেন ‘এটি একটি দারুণ খবর’ কিন্তু পরে আস্তে করে বলতেন-‘তুমি কি ঠিক আছো?’ ‘তুমি কি জান এটি তোমার কত ক্ষতি করতে পারে?’
'আমি তাদেরকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যা আমি আমার নিজেকেও দিতাম আর তা হচ্ছে-কিডনি দান করা সন্তান জন্ম দেয়ার চাইতে সহজ এবং নিরাপদ ব্যাপার। আমি তাদেরকে বলতাম, কিডনি দাতারা স্বাভাবিক মানুষের চাইতে বেশি দিন বাঁচে।’
যেটি আমাকে ভীত করতো তা হচ্ছে,আমার রক্তের চাপ বেড়ে গিয়েছিল এবং এই কারণে যদি আমি কিডনি দানের উপযুক্ত না হই তবে আমি তা মেনে নিতে পারবো না। আমি ডাক্তারের ‘না’ উত্তর শোনার জন্য তৈরি ছিলাম না।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের আগের রাতে আমি আমার পরিবারের সদস্যগণ এবং আমার বন্ধুদের কাছ থেক যে মানুষিক সমর্থন পেয়েছিলাম তাতে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গিয়েছিল।
আমরা যে হোটেলটিতে উঠেছিলাম তা আমার পরিবারের সদস্যরা সহ আমার বন্ধুবান্ধব এ পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত আমার বন্ধু আলী সবার জন্য যে সুস্বাদু স্নাক্স নিয়ে এসেছিল তা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।
ব্রায়ানের বাবা-মা আমাদের জন্য অনেক সুন্দর চিত্রশিল্প নিয়ে এসেছিলেন। বিশেষত ব্রায়ানের মা, উনাকে উনার দাদীর দেয়া একটি হিরের আংটি আমাকে উপহার দেন। তিনি আমার জন্য গর্ববোধ করেন বলেও জানান।
আমার বাবা-মা অতিথিদের জন্য পিজ্জা নিয়ে এসেছিলেন। আমার বন্ধু কেলী এবং জেরি কয়েকদিন পর্যন্ত আমার পোষা কুকুর রিওর সেবা যত্ম করেছিলো।
যখন হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল যে কিডনি দানের জন্য অস্ত্রোপচার করার সময় সুনিশ্চিত তখন আমাদের হোটেল রুমটির সবার মধ্যে আনন্দের ঝর্ণা বয়ে গিয়েছিল। সবাই একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করছিলেন।
রাত ৪ ঘটিকা বাজে, ঘড়ির এলার্ম বেজে উঠেছিলো এবং ২০ জুলাই ২০১২ সালের সকালে এই প্রথম আমার মনে ভয় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল।
আমার শিরা উপ-শিরায় ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে, ‘দাঁড়াও-আমি কি করতে চলেছি?’ পরে আমি নিজেকে বুঝালাম যে, ‘আমার নেয়া সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার আর সময় নেই।’
তবে কয়েক সেকেন্ড পরেই ব্রায়ান আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং সাথে সাথেই আমার সব ভয় কেটে গিয়েছিল। আমি নিজেকে বললাম, সিদ্ধান্তে অটল থাকো, তোমার সাতার কাটা চালিয়ে যাও। অস্ত্রোপচারের পূর্বে তৈরি হওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে দেয়া জীবাণুবিরোধী সাবান দিয়ে আমি গোসল করে নিয়েছিলাম।
এর পরেই আমি আরোরা এর মুভি থিয়েটারে গোলাগুলির বিষয়ে জানতে পারি। তখন আমার মনে এই ভীতি এসে জড় হলো যে, হাসপাতাল কি অস্ত্রোপচার বাতিল করে দিয়েছে নাকি? এই মুহূর্তে যদি আহত জনগণ হাসপাতালে এসে সকল জায়গা দখল করে নেয় তবে কি হবে? আমি আমার পিতামাতার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিলাম এবং হাসপাতালটিকে অনেকটা নীরব দেখতে পেলাম।
ব্রায়ান এবং আমি সেদিনকার অস্ত্রোপচারে সফল হয়েছিলাম। যখন আমি আমার হুশ ফিরে পেলাম এবং আমার মুখ দিয়ে বের হওয়া প্রথম শব্দ ছিলো, ‘ব্রায়ান ঠিক আছে কিনা?’। আর ব্রায়ানের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, ‘জেন কেমন আছে?’
আমার মনে আছে একদিন যখন ব্রায়ান সাইকেল চালিয়ে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছিলো আর এই দৃশ্য দেখে আমার এক বন্ধু বললো, তুমি কি ভয় পাচ্ছ না? যদি ব্রায়ান পড়ে যায় তবে কি হবে?
যদি আমি আমার সাথে সৎ থাকি তবে বলতে হয়, আমি সত্যিই ভয়ে থাকি। আমি ভয়ে থাকি এই ভেবে, যদি ব্রায়ান পড়ে যায় এবং তার নতুন কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তার কি হবে। তবে আমি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে,ভয় হীন জীবনের কোনো অর্থই নেই।
সুতরাং আমি ব্রায়ানকে বলি,‘মজা কর!’ আর যখন ব্রায়ান বন্ধুদের সাথে স্কি করতে যায়,তখন আমি তাকে আশ্বস্ত করি।
আমরা আমাদের ‘সফল কিডনি ট্রান্স-প্লান্ট’ বার্ষিকী উদযাপন করি ডেনভার হোটেলটির পাশে একটি রাত কাটিয়ে যেখানে আমরা কিডনি অস্ত্রোপচারের জন্য বসবাস করেছিলাম।
আমরা সেখানে মেক্সিকান খাবার খেয়েছিলাম এবং সূর্যাস্ত যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করেছিলাম যখন এটি গাঢ় গোলাপি মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা আমাদের গত এক বছরের জীবন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করলাম। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বললাম আমাদের জীবন কত সুন্দর।
আমি কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই জানি ভালোবাসার মানুষটির সাথে জীবন কাটানো কতটা আনন্দের! তবে তাকে হারানোর মত সাহস দেখানো সবচাইতে কঠিন বিষয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন