চীনের ঐতিহ্যগত মুসলিম উপকথা অনুযায়ী মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এর ওফাতের কিছুকাল পরেই দেশটিতে ইসলামের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের কয়েক বছর পরেই তার অন্যতম সাহাবী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রাঃ) এবং অন্য আরো তিনজন সাহাবী চীনে ইসলামের দাওয়াত দিতে সফর করেছিলেন।
চীনে সাহাবী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর এই ঐতিহাসিক ভ্রমণের প্রামাণিক দলিল সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ১৭৩৯ সালের বিখ্যাত সুফি লুই জি। পরবর্তীতে চীনের ইসলামিক বিশেষজ্ঞ লুই সানজি এবং তার পুত্র এ সম্পর্কিত দলিলগুলো সংরক্ষণ করেন।
অন্যান্যদের মধ্যে যেসকল ইসলামিক বিশেষজ্ঞরা চীনের ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- সাইয়্যেদ ওমার শামস আল-দীন(র.)। তিনি ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনে সফর করেন। অনেকের মতে তিনি ছিলেন রাসুল(সাঃ) এর ২৭তম বংশধর। সাইয়্যেদ ওমার শামস আল-দীন(র.) তৎকালীন চীনের ইয়ুআন ডাইন্যেস্টির সময়কার খুবই প্রভাবশালী ইসলাম প্রচারক ছিলেন।
ঐতিহাসিক মার্কো পোলোর মতে, সাইয়্যেদ ওমার শামস আল-দীন(র.)কে তখনকার চীনা সম্রাট তার সম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইয়ুআন সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক তাকে ইয়ুআন সাম্রাজ্যের সভ্যতার প্রবর্তক বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
সাইয়্যেদ ওমার শামস আল-দীন(র.) শুধুমাত্র তার কথা এবং কাজ দ্বারাই ইসলাম প্রচার করেননি বরং তিনি স্থানীয় জনগণের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করার মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চীনে কনফুসীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের নৈকট্য লাভ করেছিলেন।
চীনের মিং ডাইন্যেস্টির শাসনকালে মুসলিমদের গ্রহণযোগ্যতা অকল্পনীয় মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। তারা সে সময় রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চীনের কিইং রাজত্বের সময় ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। এসময় দেশটিতে অনেক বিখ্যাত মুসলিম তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের আবির্ভাব হয়েছিল। তাদেরকে একত্রে ‘হান কিতাব’ ঐতিহ্য বলে ডাকা হতো।
‘হান কিতাব’ গোষ্ঠী ইসলামী চিন্তাধারাকে চীনের বিদ্যমান জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অস্বীকার না করেই সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ওয়াং ডাইয়ু নামের একজন বিখ্যাত তাত্ত্বিকের নাম উল্লেখযোগ্য যাকে তৎকালীন চীনারা সুফি সাধু হিসেবে সম্মান করতো।
ওয়াং ডাইয়ু এর লিপিবদ্ধ নথিপত্র (Zhengjiao Zhenquan) থেকে জানা যায়, মিং ডাইন্যেস্টির পরেও চীনে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের আনাগোনা হতে থাকে।
কিইং ডাইনেস্টির আরেকজন বিখ্যাত ইসলামী বিশেষজ্ঞ ছিলেন ১৭১০ খ্রিস্টাব্দের মা জুহু। তিনি কনফুসীয় এবং ইসলামী বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার রচনা সমগ্র সমূহকে একত্র করে Qingzhen Zhinan নামের একটি বই লিখা হয়েছিল। যা ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়, ‘ইসলামের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দিক নির্দেশিকা’। এই বইটি লিখা হয়েছিল চীনের অমুসলিম সুশীল শ্রেণীকে ইসলামের শিক্ষা দেয়ার জন্য।
চীনের ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন লিউ জিহি। ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি কনফুসীয়ানিজম, বৌদ্ধাইজম, তাওইজম এবং ঐতিহ্যগত ইসলামী জ্ঞানের উপর শিক্ষা অর্জন শুরু করেন।
লিউ জিহি চীনে ইসলামের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। তিনি মুহাম্মদ(সাঃ) এর একটি জীবনী লিখেন। সেখানে তিনি মুহাম্মদ(সাঃ)কে সকল ঋষির মধ্যে সবচাইতে বড় ঋষি বলে উল্লেখ করেছেন।
চীনের বুদ্ধিভিত্তিক এবং ধর্মীয় ইতিহাস বলছে, দেশটির সংস্কৃতি ইসলামের শিক্ষাকে কখনোই অবজ্ঞা করেনি। ইসলাম চীনের জনগণের আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত করেছিল।
ওয়াং ডাইয়ু এবং লিউ জিহি এর মত ধর্ম প্রচারকরা ইসলাম এবং কনফুসিয়াসের শিক্ষার মধ্যকার সেতুবন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তথাপি, চীনের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দেশটির জনগণকে মুসলিম ধর্মবেত্তাগণের অবদানকে ভুলে গেল চলবে না।
সূত্রঃ এনএসটি ডট কম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন