ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের বিপর্যয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার প্রায় ৪০ লাখ লোক, বেশির ভাগই মুসলিম, ভারতের নাগরিক প্রমাণ করার মতো নথিপত্রের অভাবে নাগরিকত্ব হারাতে পারে।
চলতি বছরের ৩০ জুলাই জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি)১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে (ওই দিন বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল) প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লোকদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।
অবশ্য বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা আসাম রাজ্যে বসবাসকারী লোকদের জন্য তৈরি করা এই তালিকা প্রকাশ করার পর প্রায় ৪০ লাখ লোকের নাম না থাকায় তাদেরকে রাষ্ট্রহীন লোক হিসেবে রাখা হয়েছে।
আসামের তিন কোটি ২০ লাখের বেশি লোক তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য নথিপত্র দাখিল করেছিল। এদের মধ্যে ৪০ লাখের বেশি লোকের নাম প্রকাশিত তালিকায় নেই। করিমগঞ্জ, সিলচর ধুবরি জেলার অনেক লোক জানিয়েছেন, তারা ১৯৭১ সালের অনেক আগে আসামে এসেছেন। কিন্তু তবুও ভারতীয় নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে বহিষ্কারের মুখে রয়েছেন।
এ ধরনের সরকারি পদক্ষেপের ফলে রাজ্যটির অনেক মুসলিম উদ্বিগ্ন হয়ে আশঙ্কায় রয়েছে যে তাদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই বহিষ্কার করা হতে পারে। এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন স্থানীয় মুসলিম মোহাম্মদ আজমল। তিনি বলেন, তিনি প্রাসঙ্গিক সব নথিপত্র সরকারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে তার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘কিছু একটা হচ্ছে। আমদের রাজ্যে ভয়াবহ অবস্থা চলছে। আমরা এ ব্যাপারে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। ভোট ব্যাংক নিশ্চিত করার জন্য রাজ্যটি থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করার সুপরিকল্পিত এজেন্ডা থাকতে পারে।
৬২ বছর বয়স্ক আজমল আরো বলেন, ৩০ বছরেরও বেশি সময় এ দেশে বাস করার পরও রাজনৈতিক কারণে তার মতো লাখ লাখ লোককে বহিস্কার করে ক্ষমতার করিডোরে যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে।
আসাম ও কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তার হিন্দু ভোট ব্যাংক নিশ্চিত করতে এই তালিকা ব্যবহার করতে পারে – এই উদ্বেগও রয়েছে।
১ আগস্ট বিজেপি নেতা টি রাজা সিং আসামের নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে ইন্ধন দিয়ে বলেন, বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা মুসলিমরা ‘ভারতের জন্য বিপদ। তারা যদি স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ না করে, তবে তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত।’
রাজা এক বিবৃতিতে বলেন, তাদের তাড়িয়ে দিতে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি। যদি তা করা না হয়, তবে অন্যান্য দেশ যেভাবে অনুপ্রবেশকারীদের গুলি করে, ভারতেও শান্তিপূর্ণভাবে ভারত ত্যাগ না করা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের গুলি করার প্রয়োজন হতে পারে।
এই বিবৃতি নাগরিক সমাজ ও মুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে আতংকের সৃষ্টি করেছে। তারা একে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশে সহিংসতা উস্কিয়ে দেয়ার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে।
দিল্লিভিত্তিক সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট তালিব হোসাইন বলেন, এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে গরিব অভিবাসী ও মুসলিমদেরকে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে বিজেপি বেপরোয়াভাবে সাম্প্রদায়িক আবেগে ইন্ধন দেয়ার চেষ্টা করছে। এ ধরনের অর্থহীন বক্তব্যের মাধ্যমে দলটি তার ভোট ব্যাংক নিশ্চিত করার জন্য ধর্মীয় কার্ড নিয়ে খেলছে।
তিনি আরো বলেন, তালিকাটি বিজিপির ভাগ করে শাসন করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, এত দিন সরকার কোথায় ছিল? এখন দেশে নির্বাচন হতে যখন মাত্র কয়েক মাস বাকি আছে, তখন কেন সরকার হঠাৎ করে তালিকা নিয়ে এলো? আর কেন ৪০ লাখের বেশি লোককে অমর্যাদাকরভাবে তালিকা থেকে দূরে রাখা হলো?
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রসের সমর্থক শুমেন্দ্র চ্যাটার্জি বলেন, তালিকাটি জাতিগত টার্গেটকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আরো বরেন, যাদেরকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে, তারা গত নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেয়নি। তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বিজেপি তাদের নীতির বিরুদ্ধে থাকা লোকদেরকে আগামী নির্বাচনে ভোটার হিসেবে দেখতে চায় না। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে দলটি তার জন্য উইন-উইন যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার রাজন চ্যাটার্জি নয়া দিল্লিতে মিডিয়াকে বলেন, স্বাভাবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার চেয়ে এ অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রকৃতির। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি সঠিকভাবে এনআরসিকে গ্রহণ করেনি। বিজেপি নেতারা স্পষ্টভাবে বলছে যে অবৈধ অভিবাসীদের গুলি করা উচিত।
অবশ্য সারা দেশে বিরোধী দলগুলোসহ উত্তাপ আঁচ পেয়ে সরকার মনে হচ্ছে, তারা ভুল স্বীকার করছে। ১ আগস্ট তারা স্পষ্ট করেছে যে প্রকাশিত তালিকাটি স্রেফ খসড়া, চূড়ান্ত তালিকা এখনো তৈরি হয়নি।
পার্লামেন্টে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো বিষয়টি উত্থাপন করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে বলেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, চূড়ান্ত তালিকা নয়।
তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী দাবি করা বা বিরোধিতা করার পূর্ণ সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তির পরই কেবল চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। আমি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার জন্য সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, প্রক্রিয়াটি জনগণের জন্য বিপর্যয়ের সামিল। বিজেপি বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে।
তিনি ভারতীয় টিভি নিউজ চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডেকে বলেন, যা চলছে তা তামাশা। অভিবাসীরা সন্ত্রাসী নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যদি কোনো অভিবাসী অন্য দেশে আসে, তবে ওই দেশের সরকারের কর্তৃব্য হলো তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়া। বিজেপি আগুন নিয়ে খেলছে। এটি দেশে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই এটিকে থামাতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন