দ্য গার্ডিয়ান তুরস্কে চলমান অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনটি ভাষান্তরে সারাংশ আকারে আরটিএনএনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
প্রথমত, বার্তা সংস্থা রয়টার্স তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান ডলারের চাইতেও ৭ শতাংশ কমে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান সোমবার বলেন, তুরস্কের অর্থনীতির উপর আরো আক্রমণ আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দেন যে, অচিরেই তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান একটি যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে পৌঁছবে।
এরদোগান লিরার মান পড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এটি অর্থনৈতিক মূলনীতি নয় বরং এটি একটি সাজানো প্লট এবং তুরস্কের অর্থনীতি সম্পর্কে ভূয়া খবর ছড়ানো বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আঙ্কারার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা পেছন থেকে ছুরি মারার সামিল।
আবদুল্লাহ বোযক্রুট নামের একজন টুইটারে জানান, সোমবার তুরস্কের প্রতিনিধিদের সাথে এক মতবিনিময় কালে এরদোগান ট্রম্পের আচারণকে ‘রিয়েল ডোনাল্ড ট্রাম্প এগেইন’ বলে তিরষ্কার করেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প হয়তবা একজন প্রেসিডেন্ট, তার মনে এই নয় যে তিনি তার ইচ্ছামত তুরস্কের বিরুদ্ধে শুল্ক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। এরদোগান তুরস্কের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশটি পেছন থেকে চুরি চালিয়েছে এবং তার অন্যতম মিত্রের পায়ের উপর গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
এরদোগান তুরস্কের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ভূয়া খবর ছড়িয়ে দেয়া ‘বিশ্বাসঘাতকতার শামিল’ বলে আখ্যা দেন। সোমবার বিভিন্ন সোসাল মিডিয়াতে তুরস্কের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ভূয়া খবর ছড়িয়ে দেয়া প্রসঙ্গে একথা বলেন।
আমাদের আরো আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে হবেঃ এরদোগান
ব্লুমবার্গ নামের সংবাদ সংস্থা উদ্বৃতি দিয়ে খবরে বলা হচ্ছে, একটি সম্মেলনে এরদোগান দেশটির অর্থনীতির বিরুদ্ধে আরো আক্রমনের আশঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে এর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে আহ্বান জানান।
তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার ভঙ্গ করার দায়ে (যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের ধাতু আমদানীর উপর শুল্ক দ্বিগুণ করা প্রসঙ্গে) যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেন।
এরদোগান আরো যোগ করে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে পেছন থেকে চুরি চালানোর চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
বাজারের অশান্তির মধ্যেই এরদোগান তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন লিরা অচিরেই একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসবে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক লেনদেনের যে ভারসাম্যহীনতা তার ‘কোন অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই’ বলে তিনি জানান।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক বাজার ব্যবস্থায় কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত বেশী দিন টিকতে পারে না।
এজে বেল নামের একজন স্টক ব্রোকার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘সাম্প্রতিক তুর্কি লিরার পতন বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং তারা ‘ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন’ এমন একটি মানসিক অবস্থার মধ্যে আছেন। তুরস্কের মত উদীয়মান বাজারে তাদের সম্পদ ধরে রাখাটাকে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ ঝুঁকির কারণ বলে মনে করছেন এবং তারা এর চাইতেও নিরাপদ কোনো স্বর্গে তাদের সম্পদের বিনিয়োগ করার জন্য চিন্তাভাবনায় রত আছেন।’
সিটি ইন্ডেক্স এর সিনিয়র বাজার বিশ্লেষক ফিওনা চিনোকত্তা বলেন, এই সংকট মোকাবেলার জন্য তুরস্কের সরকারের হাতে অল্প কিছু দিন অবশিষ্ট রয়েছে।
তিনি জানান, দেশটির বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সংঘর্ষের ফলে লিরা ইতিমধ্যেই ডলারের চাইতে ২০ শতাংশ মান হারিয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে তুরস্কের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে মনে হচ্ছে কিন্তু দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে এই সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য মাত্র কয়েক দিন বাকী রয়েছে। যদি এই সঙ্কট ঘনীভূত হয় এবং লোন ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দেয় তবে দেশটি মারত্মক অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে এবং এর প্রভাব ইউরোপের ব্যাংকগুলোর উপরও পড়তে পারে।
তুরস্ক ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং দেশটিতে আটক যুক্তরাষ্টের ধর্মীয় যাজক এন্ড্রু ব্রানসনকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এরই জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ধাতু আমদানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যা সোমবার থেকে কার্যককর হয়।
দি গার্ডিয়ানের অর্থনৈতিক সম্পাদক ল্যারী ইলিয়ট কেন তুরস্কের সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়ানো প্রয়োজন অথবা কেন দেশটির আইএমএফের সাহায্য দরকার সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকবেলায় এরদোগান তার সমর্থকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্রুত ডলারের বিনিময়ে মূল্যহীন লিরা গ্রহণ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন তা একেবারেই হাস্যকর। এমনকি এটি বিশ্ব বাজারে এই কথা বিশ্বাস করতে সাহায্য করবে যে, তুরস্ক এমন একজন নেতার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন যিনি বাস্তবতাকে বুঝতে অক্ষম।
তুরস্কের কি করা দরকার তা একদম পরিষ্কার-
তুরস্কের তিনটি সমস্যার মোকবেলা করতে হবে- প্রথমত, তাদের অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণ; দ্বিতীয়ত এরদোগান পুনরায় নির্বাচিত হয়ে চলমান অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া উদ্যোগকে বাধা দেয়ার ব্যাপারটি; এবং তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান অচল অবস্থার বিষয়টি।
এরদোগানের জন্য এটি এখন এমন অবস্থা হয়ে দঁড়িয়েছে যে, তাকে বাধ্য হয়ে একটি পুরো প্লেট জুড়ে থাকা কেকটি খেয়ে নিতে হবে। তাকে হয়ত যাজক এন্ড্রু ব্রানসনের বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের নিকট আত্নসমর্পণ করতে হবে, কারণ যে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা নেই তেমন যুদ্ধে জড়িয়ে দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতি করে চলেছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহে তুরস্কের লিরার মান আশঙ্কাজনক হারে কমেছে
এক সপ্তাহের মধ্যেই তুর্কি লিরা ডলারের চাইতে তার এক তৃতীয়াংশ মূল্য হারিয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা বাড়িয়েছে। দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান অচলবস্থা এবং তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দেয়ার মত অবস্থান নেই দেখে বিনিয়োগকারীরা ভীতির মধ্যে রয়েছেন।
সোমবার দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগান তুরস্ক একটি ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধের’ সম্মুখীন বলে মন্তব্য করার পরেই লিরার মান স্মরণকালের সবচেয়ে নিম্নমুখী রয়েছে।
তুরস্ক তার আর্থিক অচল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য ‘ভূয়া খবর’ কে দোষারোপ করছে
স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যাচ্ছে যে, তুরস্কের প্রশাসন বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় তুরস্কের আর্থিক সঙ্কট সম্পর্কে ভূয়া খবর চড়ানো প্রতিরোধ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে।
তুরস্কের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকরা সোসাল মিড়িয়ায় যে কেউ দেশটির অর্থনীতি সম্পর্কে ‘ভূলে ভরা এবং মিথ্যা খবর ছড়াবে’ তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
ডলারের বিপরীতে লিরার দরপতনের বিষয়ে ভূয়া খবর ছড়ানোর দায়ে ইতিমধ্যেই ৩৫০টি সোসাল মিডিয়া একাউন্ট তদন্তাধীন রয়েছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট দপ্তর এক বিবৃতিতে সতর্ক করে দিয়ে জানায় যে, তুরস্কের অর্থনীতিকে নিম্নমুখী করার জন্য যৌথ প্রচেষ্টা চালনো হচ্ছে।
হুররিয়েত ডেইলি নিউজ এক প্রতিবেদনে জানায় যে, ইস্তাম্বুলের প্রধান আইন কর্মকর্তার দপ্তর দেশটির ‘অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে’ এমন হুমকি মোকাবেলায় একটি কার্যকক্রম হাতে নিয়েছে। বিশেষত দেশটির অর্থনীতির অবস্থাকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন ভূয়া খবরগুলোকে তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
‘তুরস্কের দন্ডবিধি, ব্যাংকিং আইন, পুঁজি বাজার সম্পর্কিত আইন এবং এর সাথে জড়িত আনুষাঙ্গিক আইনগুলোর উপর ভিত্তি করে তুরস্কের অর্থনৈতিকে হুমকির সম্মুখীন করে এমন ভূয়া খবরগুলো তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে।’
তুরস্কের অর্থমন্ত্রী এক বিবৃতিতে জানান, ‘তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে তুর্কি অর্থনীতি সম্পর্কে ভূয়া খবর প্রকাশের দায়ে ৩৪৬টি সোসাল মিড়ায়া একাউন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত আরম্ভ করেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন