রাজধানীর বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সহায়তায় গঠন করা হয়েছে একাধিক তহবিল। অনেক দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব তহবিলে জমা করেছেন কোটি কোটি টাকা। তবে দানের এই অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টনে নয়ছয়ের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। আবার একটি তহবিলে জমা পড়া প্রায় ৬ কোটি টাকার কানাকড়িও বিতরণ করা হয়নি।
অগ্নিকাণ্ডের প্রায় দু’মাস পার হতে চললেও ভুয়া পরিচয়ে খোলা ব্যাংক হিসাবে জমা এই অর্থ আটকে রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে পোড়া জায়গায় বহুতল ভবন তৈরিতে ব্যবসায়ী নেতারা এখন ব্যস্ত গোপন ‘দেনদরবারে’। এই ফাঁকে চাপা পড়ছে হাজারো ব্যবসায়ীর কষ্টগাঁথা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তায় ভারী হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস।
এদিকে, ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দান হিসাবে সংগ্রহ করা সাড়ে তিন কোটি টাকা বন্টনেও নয়ছয় ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। কাদের মধ্যে এই অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে ব্যবসায়ী নেতারা তা জানেন না।
জেলা প্রশাসনের কাছে সহযোগিতাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা চেয়েও পাওয়া যায়নি। স্পর্শকাতর তথ্য হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘ঈদ উপহার’ এর ৯ কোটি টাকার পুরোটা বন্টন করেননি দায়িত্বপ্রাপ্তরা। যাদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে সেই তালিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। আবার তালিকাভূক্ত সহস াধিক ক্ষতিগ্রস্থ উপহারের টাকা পাননি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানকালে ব্যবসায়ী নেতা, ক্ষতিগ্রস্থ দোকানদার, কর্মচারী ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে উল্লিখিত চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এই টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এখানে নয়ছয়ের কোনো সুযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জনপ্রতি ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ৯ কোটি টাকা বন্টনের তালিকা আপনারা কিভাবে করেছেন, তালিকাভূক্ত সবাই সহায়তা পেয়েছে কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুধু আমরা নয়, বিভিন্ন সংস্থা তালিকা করেছে।
তালিকাভূক্ত প্রায় সবাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। ১ হাজার ১০০ মানুষের হিসাব নম্বরে টাকা যায়নি।’ সহায়তা পাওয়া ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের তালিকার কপি দেওয়ার অনুরোধ জানালে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তালিকা দেওয়া ঠিক হবে না। তালিকাভূক্তদের নাম প্রকাশ পেলে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।’
গত ৪ এপ্রিল রহস্যের আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায় ব্যস্ততম বঙ্গবাজার ও আশপাশের বেশ কয়েকটি মার্কেট। অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী ও দেশের দানশীল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরপরই তৎপর হয় সিন্ডিকেট। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি নাজমুল হুদা ও যুগ্ম সম্পাদক মোঃ জহিরুল হকের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে তহবিল গঠনে যৌথ হিসাব খোলা হয়।
হিসাব খোলার সময় প্রতারণার মাধ্যমে নাজমুল হুদা নিজেকে বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও জহিরুল হক নিজেকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। আড়ালে রেখেছেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি শাজাহান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হককে।
জানা গেছে, এই হিসাব নম্বরে এ পর্যন্ত ৫ কোটি ১৯ লাখ ১২ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে দেওয়া ১ কোটি টাকার চেক নগদায়নের অপেক্ষায় আছে। এই টাকা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে বিতরণের কোনো উদ্যোগ নেই।
অভিযোগ আছে, কিশোরগঞ্জের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের মদদে সমিতির বৈধ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কোনঠাসা করে দীর্ঘ দিন ধরেই বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন নাজমুল, জহিরুল সিন্ডিকেট। অবৈধ দোকান বাণিজ্য থেকে শুরু করে ভারতীয় কাপড় নামাতে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় ও বন্টনের সব কাজই তাদের কব্জায়। এখন বহুতল ভবন নির্মাণের আলোচনায়ও তারা সামনের সারিতে।
মার্কেটে পাকা ভবন হলে দোকান বরাদ্দসহ নানা খাত ঘিরে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। তাই ‘হালুয়া রুটির’ ভাগ বসাতে দেনদারবারেই তাদের আগ্রহ বেশি। তহবিলে জমা হওয়া টাকা ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণে তাদের আগ্রহ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্থ দোকান মালিক ও ভাড়াটিয়াদের তালিকা করে সিটি কর্পোরেশনে জমা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ২ হাজার ৯৬১ জন এবং মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের ৭৯১ জনের নাম রয়েছে।
যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তালিকাভূক্ত ব্যবসায়ীদের কেউ এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ সহায়তা পাননি। ভাড়াটিয়া তালিকার দুই নম্বরে থাকা কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার একটি দোকান ও দুটি গোডাউন ছিল। আগুনে ২০ লাখ টাকার উপরে ক্ষতি হয়েছে। এখন চৌকি পেতে ব্যবসা শুরু করেছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী, জেলা প্রশাসকসহ অনেকেই অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু আমি পাইনি।’
তালিকাভূক্ত ১০ জন ব্যবসায়ী ও ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বললে সবাই বলেছেন, তারা কেউ কোনো অনুদান বা অর্থ সহায়তা পাননি। কেউ কেউ বলেন, তাদের সামনে রেখে তহবিল সংগ্রহ করা হলেও কে কিভাবে তালিকা করেছে, কাদের অনুদান দিচ্ছে তা স্বচ্ছ নয়। সব কিছুতেই নয়ছয় চলছে।
জানতে চাইলে নাজমুল হুদা বলেন, ‘অনুদানের টাকা ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণ করা হবে নাকি মার্কেট পুনর্গঠনের কাজে লাগানো হবে সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগিতার নামে তোলা দানের টাকা মার্কেট পুনর্গঠনের কাজে লাগানোর চিন্তা কেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মেয়র সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ী নেতাদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় ঢাকা জেলা প্রশাসন। তারা এ পর্যন্ত সাড়ে তিন কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। শিল্পকলা একাডেমী ও শিশু একাডেমিতে ক্ষতিগ্রস্থদের ডেকে এই তহবিলের টাকা দেওয়া হয়। সহায়তা দিতে ১ হাজার ২০০ দোকান কর্মী ও ৬০০ ব্যবসায়ীর তালিকা করেছেন তারা। তবে কাদের নাম তালিকাভূক্ত হয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারেননি ওই কর্মকর্তা। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন কোনো ব্যবসায়ী ভাড়াটিয়া বা কর্মচারীর সন্ধানও পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহাজান মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকৃত দোকানদারদের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মোবাইল ফোনে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা উলটা পালটা লিস্ট করে পাঠালো। এতে বঞ্চিত হলো দোকানদাররা। এই টাকা কাদের মাধ্যমে কাদের মোবাইলে পাঠানো হয়েছে তা তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে যাবে। এমপি সাহেব ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দিয়ে এসব করিয়েছেন।’
একাধিক ব্যবসায়ী নেতা জানান, জেলা প্রশাসন কাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে, কাদের দিয়েছে-এ বিষয়ে মার্কেট সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় করেনি। তারা ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা কোথায় পেয়েছে তাও জানেন না। তবে একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, অগ্নিকান্ডের পরদিন জেলা প্রশাসন সরকারী কর্মচারী হাসপাতালের পাশে অস্থায়ী ক্যাম্প করে স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করেছিল।
যারা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন, তাদের নাম তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়েছিল। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা তখন তালিকায় নাম দিতে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ছিলেন না। তবে অর্থ সহায়তা পাওয়ার কথা শুনে স্থানীয় অনেক ভবঘুরে ও দরিদ্র লোকজন ওই তালিকায় নাম তুলেছিল। এই তালিকাই জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। এদেরই প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৯ কোটি টাকা ‘ঈদ উপহার’ হিসাবে পাঠানো হয়েছে। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা বেশির ভাগই বঞ্চিত হয়েছেন।
তালিকার কতজনকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের টাকা দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ ২ হাজার ৮০০ ব্যবসায়ী ও ৩ হাজার ১০০ কর্মচারীর তালিকা পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ নম্বরে টাকা যায়নি। অন্তত চার হাজার জনকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের দেওয়া এই হিসাবেরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম মনিরুজ্জামানের মোবাইল নম্বরের হোয়াটস অ্যাপে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে এ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে কথা বলার সময় চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে ফিরতি ক্ষুদে বার্তায় তিনি কথা বলার প্রসঙ্গ জানতে চান। সুনির্দিষ্ট বিষয় ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রাপ্তদের তালিকা প্রয়োজন জানিয়ে ফের ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি বার্তাটি সিন করলেও জবাব দেননি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন