বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) নারীকর্মীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর বেশিরভাগ নারীকে তার কুনজরে পড়তে হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, মাসুমের যৌন হয়রানির বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানের সবাই জানেন। বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানির শিকার নারীরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছে, কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সামাজিক সম্মানহানি, চাকরি হারানোর ভয় ও দাপ্তরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে এতদিন কেউ তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেননি। এবার ভয় এড়িয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত এক নারী।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে আলাপকালে ওই নারী বলেন, ‘মাসুমের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সব যোগ্যতা থাকার পরও গত ১২ বছর ধরে নিয়মিত বেতনের বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি।’
তিনি গত ১২ এপ্রিল বাইগামের প্রশাসক ড. মো. মোকতার হোসেনের কাছে মাসুমের যৌন হয়রানির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তার অভিযোগের পর উপ-পরিচালক দেবব্রত দাস ও সহকারী পরিচালক খন্দকার নুরুন্নাহারের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ওই নারী জানান, তিনি অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন, প্রশাসন বিভাগে। মাসুম তার সিনিয়র হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিছুদিন পর থেকে মাসুম তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। বিষয়টি তখন মৌখিকভাবে প্রশাসনকে জানালে তাকে প্রশাসন বিভাগ থেকে সরিয়ে হাসপাতাল বিভাগে ডিউটি দেওয়া হয়। বদলির কিছুদিন পর হাসপাতালের ডিরেক্টরের পিএ নবীউল ইসলাম আকাশের মাধ্যমে মাসুম প্রস্তাব পাঠান, তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়লে প্রবীণনিবাসে অনুদান পাওয়া ৬টি কম্পিউটারের একটি তার বাসায় পাঠানো হবে। বিষয়টি তৎকালীন মহাসচিব ডা. এ এস এম আতিকুর রহমানের কাছে জানালে তিনি মাসুমকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ওই ঘটনার পর মাসুম কিছুদিন নীরব থাকেন। তারপর মাসুম আবার আকাশকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠান, তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে যত টাকা লাগে দেওয়া হবে। তিনি তাতে রাজি হননি।
ওই নারী বলেন, ‘২০১৮ সালের পহেলা বৈশাখের রাতে অ্যাটেনডেন্ট বিভাগের এক নারী সহকর্মী বাসায় দাওয়াত দেন। সেখানে গিয়ে দেখি, মাসুম বসে আছেন। সেদিন অনেক চেষ্টায় তার হাত থেকে রেহাই পাই। পরদিন ইসি (মিনিং) কমিটির অনেক সদস্যকে বিষয়টি জানাই। প্রশাসন বিভাগের ডিডি বদরুল আহসান ‘স্যার’কেও জানাই। তিনি বিচার না করে আমাকে চুপ করে থাকতে বলেন এবং এ নিয়ে কথা বললে চাকরি নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারি বলে জানান।’
জানতে চাইলে বদরুল আহসান জানান, ‘আমাকে কখনো তিনি লিখিত বা মৌখিকভাবে মাসুমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। তার যৌন হয়রানি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে সম্প্রতি মাসুমের বিরুদ্ধে প্রশাসকের কাছে একটা অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে।’
ওই নারী বলেন, ‘মাসুম স্যার আমাকে মাঝেমধ্যেই যৌন হয়রানি করেন সেটা আমাদের অফিসের সবাই জানে। তার কথায় সায় না দেওয়ায় এই অফিসে ১২ বছর চাকরি করেও আমি প্রমোশন বা ইনক্রিমেন্ট পাইনি। অফিসে ভয়ে থাকি।’
মাসুমের যৌন হয়রানির শিকার আরও কয়েকজন নারী পরিচয় গোপন রেখে বলেন, ‘তিনি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের নানাভাবে যৌন হয়রানি করেন। উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তিনি টার্গেটকৃত নারীকর্মীদের চাকরি সংক্রান্ত নানা সমস্যা তৈরি করে রাখেন। সেসব সমস্যা নিয়ে নারীকর্মীদের তার কাছে ধরনা দিতে বাধ্য করেন। তার কাছে গেলেই তিনি নানা অনৈতিক প্রস্তাব দেন। রাজি না হলে চাকরি স্থায়ীকরণ, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য সুবিধা আটকে দেন। বিশেষ করে তৃৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নারীকর্মীদের বিপাকে ফেলে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেন।’
সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ আনা হয়েছে। আশা করি, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব।’
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘মাসুমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নারীরা যৌন হয়রানির অভিযোগ করছেন। তার আচরণ ও কাজকর্ম সন্দেহজনক। মৌখিকভাবে নারীরা অভিযোগ জানালেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
বাইগামের প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোকতার হোসেন জানান, ‘মাসুমের বিরুদ্ধে একজন নারী কর্মচারী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাব। প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন