রাজশাহীতে মানববন্ধন করেছেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা। এতে জেলার বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। শনিবার শহরের সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টেছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভার) শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা প্রত্যাহার চেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। আজ শনিবার এসব কর্মসূচি থেকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি জানানো হয়েছে।
‘দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে’
রাজশাহীতে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘সাংবাদিক নির্যাতনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। প্রথম আলো সম্পাদকের মতো একজন বিশিষ্ট নাগরিককে হয়রানি এবং রাতের অন্ধকারে পত্রিকাটির নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’
আজ দুপুরে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী।
রাজশাহীতে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘হেরিটেজ রাজশাহী’ সংবাদ সম্মেলন করেছে। শনিবার দুপুরে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো
লিখিত বক্তব্যে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লাগামহীন অপপ্রয়োগ চলছে। ফলে দেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অনেক সাংবাদিক পেশা পরিবর্তন করছেন, অনেকে দেশান্তরি হয়েছেন। দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নেই বললেই চলে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট চললেও এসব সংবাদ প্রকাশ কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।’
কোনো সংবাদ প্রকাশে কোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রতিবাদ জানাতেই পারেন এবং প্রচলিত আইনে প্রতিকারও চাইতে পারেন। কিন্তু এভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা আইনের শাসনের পরিপন্থী বলে মনে করেন মাহবুব সিদ্দিকী।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে গণমামলা দেওয়া ও গ্রেপ্তার করার ফলে দেশে মুক্তচিন্তা, বাক্স্বাধীনতা ও স্বাধীন সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠ রোধ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম, আইনজীবী হাসনাত বেগ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আজ বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে বন্ধুসভার আয়োজনে মানববন্ধন হয়েছে। এতে রাজশাহীর নয়টি সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
বন্ধুসভার সহসভাপতি মো. জাহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে স্বাগত বক্তব্য দেন রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি সাব্বির খান।
এতে আরও বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান, হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্য মাহমুদ জামান কাদেরী, রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু, সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) রাজশাহীর কোষাধ্যক্ষ কে এম জোবায়ের, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামরুল হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর প্রমুখ।
আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম বলেন, যে প্রতিবেদনের কথা বলা হচ্ছে, একজন খেটে খাওয়া মানুষের মনের কষ্ট সেখানে তুলে আনা হয়েছে। এ জন্য রাতের আঁধারে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এখন ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে প্রথম আলো সম্পাদককেও হয়রানি করা হচ্ছে। মামলা প্রত্যাহারসহ আইনটি বাতিল করতে হবে। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘প্রথম আলো সাহস নিয়ে সত্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা সব সময় নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার চাই ক্ষুধার মুক্তি ও স্বাধীনতা। একজন সাংবাদিক ক্ষুধা নিয়ে সংবাদ করেছে। আর রাষ্ট্র তাঁর সব শক্তি দিয়ে গভীর রাতে তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে—যা চরম অন্যায়।’
রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু বলেন, ‘সাংবাদিকের ভুল হলে বাংলাদেশে প্রেস কাউন্সিল আছে, যেখানে সংক্ষুব্ধ হলে যে কেউ যেতে পারেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে কারাবন্দী করা হবে কেন? অন্য সবার মতো আমরাও এই সরকারের কাছে দাবি জানাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামান কাদেরী বলেন, ‘যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করেছি, আন্দোলন করেছি, তার মধ্যে বাক্স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা অন্যতম। এই স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবেন না।’
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ইতিহাস পরিষদের সদস্যসচিব শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম, বন্ধুসভা রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক মো. লুৎফর রহমান, সাংঠনিক সম্পাদক পরওয়ার হোসেনসহ রাজশাহীর বিভিন্ন ইউনিটের বন্ধুসভার সদস্যরা।
কেশবপুর বন্ধুসভার উদ্যোগে উপজেলা শহরের ত্রিমোহিনী মোড় চত্বরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। শনিবার বিকেলে ছবি: প্রথম আলো
‘কলম অবরুদ্ধ হলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়’
কেশবপুর বন্ধুসভার উদ্যোগে আজ বিকেলে শহরের ত্রিমোহিনী মোড়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি এস এম শরিফুল ইসলাম।
সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন কেশবপুর নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিকী, খেলাঘর আসরের উপজেলা সভাপতি আবদুল মজিদ, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক আজিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জয়দেব চক্রবর্তী, বেগমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বপন মণ্ডল, সাংবাদিক ওয়াজেদ খান, মতিয়ার রহমান ও প্রথম আলো প্রতিনিধি দিলীপ মোদক।
আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, কলম অবরুদ্ধ হলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সাংবাদিকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্ত আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার এবং প্রথম আলো সম্পাদককে মামলা দিয়ে হয়রানি করা চরম অন্যায়।
আবদুল মজিদ বলেন, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও তাঁদের মামলা দিয়ে এ দেশের গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সবাইকে একযোগে রাস্তায় নামতে হবে, প্রতিবাদ জানাতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি কালো আইন। এ আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোট মৌলভীবাজার জেলা শাখা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরেছবি: প্রথম আলো
এ ছাড়া আজ দুপুরে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে বাম গণতান্ত্রিক জোট মৌলভীবাজার জেলা শাখা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মকবুল হোসেন।
সিপিবি জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহরলাল দত্তের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সমন্বয়ক মঈনুর রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি বিশ্বজিৎ নন্দী, ছাত্র ইউনিয়ন মৌলভীবাজার জেলা সংসদের সভাপতি তপন দেবনাথ প্রমুখ।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, মৌলভীবাজার; প্রতিনিধি, রাজশাহী, কেশবপুর, যশোর]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন