জিম্মাদারির লড়াই শুরু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কে হবে জিম্মাদারÑ শিশুদের বাবা নাকি মা? জাপানে জন্ম নেওয়া দুই শিশুর অভিভাবকত্ব ও হেফাজত নিয়ে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো ও তার স্বামী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফের দ্বন্দ্ব চলছেই অশেষ সেই ফ্যামিলি ডিসপুট। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশের আদালত শিশুদের জিম্মা মা নাকানো এরিকোকেই দিয়েছে।
তবু দ্বন্দ্ব নিঃশেষিত হয়নি। অধস্তন আদালত, হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ, আবারও অধস্তন আদালত; অতঃপর আবারও আপিল। মাতৃত্ব-পিতৃত্বের দাবির লড়াই এখনো থামেনি। চলছে। গত রবিবার পারিবারিক আদালতের রায়ে যখন দুই মেয়েকে মায়ের জিম্মায় দেওয়া হয়, হতাশায় ভেঙে পড়েন বাবা ইমরান শরীফ।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতপাড়ায় কথা হয় বাবা ইমরান শরীফের সঙ্গে। ছলছল চোখে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিতৃত্বের দাবি প্রতিষ্ঠায় এত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়! আদালত বলেছে, দুই মেয়ের মায়ের কাছে থাকাই মঙ্গলজনক। তিনি বলেন, আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বাবা হিসেবে আমার ভূমিকা কী? আমার কি কিছুই পাওয়ার নেই? নাকানো সন্তানদের পেটে ধরেছে। কিন্তু আমারও তো ঔরসজাত তারা। আমি কি তাদের কাছে পাব না? নাকানো সবকিছুর বিনিময়ে সন্তানদের চাইছে। আমিও তো তা-ই চাইছি। আমার পিতৃত্বের অধিকার ছিনতাই হয়ে যাবে! নিজের সন্তানের দাবি কি কোনো বাবা কখনো ছেড়ে দেয়!
বাবার ভরসা এখন মেয়ে লায়লাকে ঘিরে। তাও তার জিম্মাদার তিনি শেষ পর্যন্ত হতে পারবেন কি না সন্দেহ। ওই মেয়ে কিন্তু বাবার কাছেই থাকতে চায়। আদালতের রায়ের পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘বাবাকে ছাড়া কোথাও যাব না।’ এও এক মানসিক পীড়নের কারণ। বিষয়টি আদালতের বিবেচনাধীন। যা হওয়ার তা আইন অনুযায়ীই হবে। তবে ইমরান আশা করেন আদালত তার পিতৃত্বের দাবি আমলে নেবে।
১৩ ও ১১ বছর বয়সী দুই শিশুর জিম্মা পেতে ইমরান শরীফের মামলা গত ২৯ জানুয়ারি খারিজ করে রায় দেয় ঢাকার একটি পারিবারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে ইমরান শরীফের করা আপিলের শুনানির জন্য ঢাকার পারিবারিক আপিল আদালত (জেলা ও দায়রা জজ) ১৬ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছে। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। এ আইনি জটিলতার শেষ কবে জানি না। তবে পিতৃত্বের দাবির লড়াইয়ে থামাতে চাই না। আমি পারিবারিক আদালতে ন্যায়বিচার পাইনি। এখন আপিলের রায়ের অপেক্ষা করছি। আশা করি ন্যায়বিচার পাব। যদি এতেও হেরে যাই উচ্চ আদালত আছে। বাবা হিসেবে আমার দাবি কেউ না কেউ দেখবে।
নাকানো এরিকোর আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, রায়ের নির্দেশনা না মেনে ইমরান শরীফ মেয়ে লায়লা লিনাকে নিয়ে উধাও হয়ে যান। গত ৩০ জানুয়ারি এ নিয়ে গুলশান থানায় জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করা হয়। গত বুধবার ভোরে র্যাব গুলশানের কালাচাঁদপুরের একটি বাসা থেকে তাদের উদ্ধার করে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে। সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, গুলশান থানায় ইমরান শরীফকে আদালতের রায়ের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আবেগী পিতা অবোধ, কিছু মানতে চাইছেন না। এরপর মেয়েকে ওইদিন পাঠানো হয় তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।
গতকাল জিডির সূত্রে বিষয়টি আবারও আদালতে আসে। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান বিষয়টি তার এখতিয়ারে নেই জানিয়ে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে পাঠান। মহানগর হাকিম মো. মামুনুর রশীদ উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনে দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চান। বিচারকের খাস কামরায় কথা বলার পর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে বলা হয়, পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লায়লা এক দিন থাকবে বাবার কাছে, এক দিন থাকবে মায়ের কাছে।
এই আদেশের পর কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু লায়লা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সে বাবাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। আদালতে সে সময় নাকানো এরিকো ও তাদের বড় মেয়ে জেসমিন মালিকা ছাড়াও উভয়পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। ইমরান শরীফ বলেন, আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছে। আমি নাকি সন্তানকে নিয়ে উধাও হয়েছি। আমি তো ফৌজদারি মামলার আসামি নই। আদালত রায় দিয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু আমার সন্তানের পরিচয় তো মুছে যায়নি।
ওই রায়ের পর নাকানো বড় মেয়েকে নিয়ে জাপান চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আদালতের রায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ইমরান শরীফের আইনজীবীরা বলেন, পারিবারিক আদালতের রায়ে মা তার সন্তানদের হেফাজতে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পাননি। তবে নাকানো এরিকোর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির দেশ রূপান্তরকে বলেন, আদালত দুই শিশুকে মায়ের হেফাজতে দিয়েছে। এরপর তিনি সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন সেটি তার ও তাদের বিষয়। পিতা হিসেবে সন্তানের প্রতি আবেগ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আদালতের রায় মানতে হবে।
দুই বছর ধরে কেন এ জটিলতা এ প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাপানের একক অভিভাবকত্ব আইন হিসেবে পরিচিত সিভিল ল ‘সিঙ্গেল প্যারেন্ট কাস্টডি ল ইন জাপান’ অনুযায়ী স্বামী ও স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলে বা তারা পৃথক হলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাবা বা মা যেকোনো একজনের হেফাজতে বা অভিভাবকত্বে থাকবে। জাপানের বাইরের নাগরিকের ক্ষেত্রে এ আইন বড় সমস্যা তৈরি করে।
ইমরান শরীফের আইনজীবী নাসিমা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পারিবারিক আদালতের রায় পড়ে মনে হয়েছে, বাবার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সন্তানের অধিকার মা-বাবা দুজনেরই আছে। দুই বছর ধরে এ শিশুসন্তানরা অনেক মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তিনি বলেন, জাপানের ওই আইন পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের দাবির প্রতি বড় বাধা। সেটা তাদের সমস্যা। নাকানো এরিকো যদি দুই মেয়েকে নিয়ে জাপানে চলে যান তাহলে বাবা হিসেবে ইমরান শরীফ কী পাবেন? এটি যেকোনো পিতার জন্য বেদনাদায়ক হবে। অন্তত একজন সন্তানকে কাছে রাখতে চাইছেন ইমরান শরীফ। সেটিও বেশ কঠিন মনে হচ্ছে।
প্রকৌশলী ইমরান শরীফ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মসূত্রে জাপানের টোকিওতে গিয়ে পরিচয় হয় চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে। ২০০৮ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের তিন কন্যাসন্তান। এ দুই মেয়ে ছাড়াও দুজনের পাঁচ বছর বয়সী আরও একটি সন্তান রয়েছে টোকিওতে। পারিবারিক কলহে ইমরান শরীফ বড় ও মেজো মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন ২০২১ সালে। নাকানোর অভিযোগ, তথ্য গোপন করে দুই মেয়েকে তার কাছ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
দুই মেয়েকে পেতে নাকানো এরিকো বাংলাদেশে এসে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন। ওই বছরের ২১ নভেম্বর এক রায়ে ইমরান শরীফের জিম্মায় দুই শিশু থাকবে বলে রায় দেওয়া হয়। তবে শিশুদের মা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নাকানোর আইনজীবীরা। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের আদেশে দুই শিশুকে তাদের মা নাকানো এরিকোর জিম্মায় আপাতত রাখার আদেশ দেয়। এ সময়ে বাবা দিনের নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানদের সান্নিধ্য পাবেন বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়। পরে এ আদেশের সময়কাল কয়েক দফায় বাড়ানো হয়। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দুই শিশু আপাতত মায়ের কাছে থাকবে আদেশ দিয়ে মামলাটি পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন