দুয়ারে কড়া নাড়ছে শীত। এরই মধ্যে যশোরের শার্শা উপজেলায় গাছিদের মধ্যে শুরু হয়েছে খেজুরের রস সংগ্রহের তোড়জোড়। এখনো শীত জেঁকে না বসলেও জেলার সবখানে খেজুরগাছ প্রস্তুত করা হয়েছে। মাঠের আইলে, রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা খেজুরগাছ থেকে শীত মৌসুমে জেলার কয়েক হাজার গাছি রস ও গুড় উৎপাদন করেন।
এতে তারা যে অর্থ উপার্জন করেন, তাতে তাদের বছরের অর্ধেক সময়ের জীবিকার ব্যবস্থা হয়।
বিভিন্ন কারণে খেজুরগাছ কমে গেছে। আগে যেমন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ঘরে রস-গুড় উৎপাদন হতো, এখন কৃষক খেজুরের রস উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অধিক পরিশ্রম হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কৃষকের মধ্যে রস-গুড় উৎপাদনে তেমন আগ্রহ নেই। এর ফলে খেজুরগাছ থাকলেও গাছির সংকটে সব গাছ উৎপাদনে নেওয়া হয় না। শীত এলে গাছিরা প্রস্তুতি নেন। খেজুরগাছের উপরিভাগের নরম অংশে কিছুটা কেটে বা চেঁছে রস নামানো হয়। গাছ সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিক করে কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি ওই কাটা অংশে পড়তে পারে। একবার গাছ কেটে দুই-তিন দিন রস পাওয়া যায়।
kalerkantho
যশোরে প্রায় ১৬ লাখ খেজুরগাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গাছে রস উৎপাদন হয়। যশোরে যেমন কমছে খেজুরগাছ, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছি সম্প্রদায়ও। এসব সংকটে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে খেজুরের রস। আর বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এ রসের স্বাদ, পাটালি গুড় বা রসে ভিজানো পিঠা-পায়েস খাওয়ার আনন্দ।
একসময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহ করতেন গাছিরা।
জেলা-উপজেলার প্রতিটি গ্রামে অসংখ্য খেজুরগাছ ছিল। তখন প্রতিটি গ্রামে গড়ে আট থেকে ১০ জন পেশাদার গাছি পাওয়া যেত। এখন আর সেদিন নেই। গাছিদের পেশা বদল, নতুন করে এ পেশায় কেউ না আসার কারণে প্রতি গ্রাম তো দূরে থাক, কয়েক গ্রাম খুঁজলেও একজন পেশাদার গাছির সন্ধান মিলবে না।
শার্শা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, খেজুরগাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। আগে খেজুরগাছের যেসব বাগান ছিল, এখন আর তা অবশিষ্ট নেই। নতুন করে এখন আর কেউ বাগান করছে না।
মাঠে কিংবা রাস্তার ধারে অল্প-বিস্তর যেসব গাছ আছে, তারও বেশির ভাগ পড়ে আছে। অল্প কিছুসংখ্যক খেজুরগাছ কাটা হয়েছে। অনেকে বলছেন, আগে শীত এলে গ্রামে গ্রামে খেজুরের রসে ভেজানো ‘রসের পিঠা’ খাওয়ার যে ধুম পড়ত, তা এখন খুব একটা চোখে পড়ে না।
উপজেলার বাহাদুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান বলেন, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যশোরে খেজুরগাছ বিলুপ্ত হওয়া শুরু হয়। খেজুরগাছ জ্বালানি হিসেবে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। অন্যদিকে খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় এই গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত গাছিরা চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
যেসব গাছ অবশিষ্ট আছে, সেগুলো এখন গাছির অভাবে পড়ে রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই গ্রাম-বাংলা থেকে হারিয়ে যাবে খেজুরের রস। দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাবে পাটালি গুড়।
বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের গাছি কোরবান আলী (৬০) বলেন, 'আগে শীতকালে শত শত গাছ কাটিছি। অনেক রস পাতাম। রস বাজারে বিক্রি করতাম। জ্বালিয়ে গুড় বানাতাম। গুড় পাটালি বাজারে বিক্রি করতাম। শীত আসলিই বেশ টাকা আয় করতাম। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই দিন কাটত। কিন্তু এখন এলাকায় তেমন একটা খেজুরগাছ নেই। যা আছে তা মালিকরা নিজেদের জন্য কাটাচ্ছে। তাই কাজ না পেয়ে গাছিরাও অন্য পেশায় চলি যাচ্ছে।
ভবারবেড় গ্রামের গাছি ইউনুচ আলী জানান, শীতকালে আগে শহর থেকে মানুষ দলে দলে আসত খেজুরের রস খেতে। সন্ধ্যায় গ্রামীণ পরিবেশ খেজুরের রসকে কেন্দ্র করে জমে উঠত। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ করা যেত সেই সময়ে। এখন আর তেমনটি লক্ষ করা যায় না। তবে খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে। দামও ভালো পাওয়া যায়।
কাগজপুকুর গ্রামের মো. আলাউদ্দিন জানান, তিনি এবার ১০০ খেজুরগাছ প্রস্তুত করেছেন রস নেওয়ার জন্য। দুই-তিন মাসের রস-গুড় বিক্রির অর্থ দিয়ে তার বছরের পাঁচ-ছয় মাস সংসার চলে। তিনি আরো জানান, খেজুরগাছ প্রস্তুত করার পর খেজুরের যে পাতা পেয়েছেন, সেগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি করবেন। এগুলো বাজারে বিক্রি করে বাড়তি অর্থ আয় করার কথা জানান তিনি।
শার্শার শ্যামলাগাছি গ্রামের গাছি আমিনুর রহমান জানান, বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে একসময় হয়তো এলাকায় গাছ দেখা যাবে না। এলাকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাইলে কৃষকের বেশি করে খেজুরগাছ লাগানো এবং তা পরিচর্যা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
প্রায় ৪০ বছর খেজুরগাছ কেটে রস বের করছেন সামটা গ্রামের গাছি উজির আলী (৭২)। প্রবীণ এই গাছি বলেন, খেজুরগাছ কেটে এখন আর পেট চলে না। বয়স হয়েছে, তাই গাছির পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
বেনেখড়ি গ্রামের আবু জাফরের ছেলে আবু হানিফ (৪০) বলেন, তাঁর বাবা একজন পেশাদার গাছি ছিলেন। বাবার কাছ থেকে খেজুরগাছ ছোলা শিখেছেন হানিফ।
তিনি বলেন, খেজুরগাছ ছোলা কঠিন ও কষ্টের কাজ। সাত-আট বছর ধরে কাজটি আমি করছি। তবে বাবার মতো আর পেশাদার হিসেবে নয়। শৌখিন গাছি হিসেবে অল্প কিছু গাছ কেটে রস বের করছি।
উপজেলার বড়বাড়িয়া গ্রামের শাহাজান কবির বলেন, পাঁচ বছর আগেও আমাদের প্রায় ৫০-৬০টি খেজুরগাছ ছিল। তখন অনেক রস পেতাম। বাড়িতে গুড় বানাতাম। কিন্তু গাছির অভাবে আমরা আর রস উৎপাদনে যেতে পারিনি। এখন কিনেই খাওয়া লাগে। গাছগুলোও বিক্রি করে দিয়েছি।
যশোরের শার্শা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রতাপ মণ্ডল বলেন, উপজেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ৫২ হাজার ২৮০টি। এর মধ্যে মোট ফলন্ত (রস দেওয়া) গাছের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫২০টি।
তিনি বলেন, খেজুরগাছ কেটে রস বের করা একটা শিল্প। কিন্তু সেই শৈল্পিক পেশাদার গাছি এখন তো চোখেই পড়ে না। গাছির অভাবে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় না। আর টাকার লোভ দেখিয়ে এই অনাবাদি খেজুরগাছগুলো অবৈধ ইটভাটার মালিকরা কেটে নিয়ে যান।
নতুন করে গাছ রোপণ কম, অনাবাদি পড়ে থাকা, অনাগ্রহ, ভেজাল গুড় তৈরিসহ নানা কারণে যেমন খেজুরগাছ হ্র্রাস পাচ্ছে, তেমনি খেজুরগাছ কমে যাওয়া, রস ও গুড়ের ঐতিহ্য হারানোর কারণে গাছিও কমে যাচ্ছে। এর মধ্যেও উপজেলায় ৪৬০ জন গাছি এখনো টিকে আছেন বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, জেলায় প্রায় ১৬ লাখ খেজুরগাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গাছে রস উৎপাদন হয়। এসব খেজুরগাছ থেকে বছরে পাঁচ কোটি লিটারের বেশি রস উৎপাদিত হয়। এই রসে বছরে গুড় উৎপাদিত হয় প্রায় ৫২ লাখ কেজি। যার মূল্য শত কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে জেলায় ১৩ হাজার ১৭৩ জন গাছি রয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন