বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতার মধ্যে দেশের রিজার্ভের ওপর চাপসহ নানা বিষয় সামনে আসায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কমে আসছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ইভিএম থেকে সরে এলে রাজনীতিতে এখন ইভিএমকেন্দ্রিক যে বিতর্ক তাও নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীনরা।
ওই সূত্রগুলোর দাবি, ইভিএমের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশের একমাত্র কারণ রিজার্ভ খরচে লাগাম টানা। ২০২৩ সালে দেশের অর্থনীতিতে গভীর সংকটের আশঙ্কা ইতিমধ্যে সরকারপ্রধানও প্রকাশ করেছেন। ফলে সরকার মনে করছে, এসময় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে আরও ভয়াবহ বিপদ দেখা দিতে পারে। তাই দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে না উঠলে মোটা অঙ্কের রিজার্ভ খরচ করে ইভিএম কেনার পক্ষে নন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও।
সূত্রের দাবি, ভোটের এই যন্ত্রটি আমদানিনির্ভর। লেনদেন করতে হবে বিদেশি মুদ্রায়, বিশেষ করে ডলারে। তাতে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রে। তা ছাড়া বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিষয়ে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পেশাজীবী মহলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শুধু তাই নয়, ইভিএমে ভোট কারচুপি করে ক্ষমতায় আসতে চায় আওয়ামী লীগ এমন প্রচারও চালানো হচ্ছে। তাই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রিজার্ভের ওপর চাপ ও রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের বিরূপ সমালোচনা এসব আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ইভিএমে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
Video Player is loading.
Pause
Unmute
Remaining Time -8:12
Fullscreen
Close PlayerUnibots.in
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে সবকিছুই পরিচালনা করতে চান মিতব্যয়ের কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ জরুরি না হলে রিজার্ভে চাপ পড়বে এমন কিছু তিনি করতে চান না। তাই আগে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, তা পরিবর্তন হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ একাধিক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েক নেতার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় ইভিএম নিয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া হবে। তবে কমিশনের হাতে যা আছে তাতে ৫০ আসনের বেশি ইভিএমে ভোট করা সম্ভব নয়। ফলে ইভিএম মেশিন কেনা নিয়ে তৎপরতাও শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন ব্যয় পরিকল্পনা প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পাঠানো হয়েছে। তবে এই প্রকল্প এডিপিতে পাস হবে কী-না তা নিয়ে নিশ্চিত নয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রস্তাবনা এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। জনবল যাচাই বিভাগে।
ইসি সূত্র জানায়, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ইভিএম মেশিন কিনতে হলে সরকারকে ব্যয় করতে হবে ৬শ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার এ খরচের মধ্যে চলতি অর্থবছরেই ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এমনিতে জ্বালানি ঘাটতিতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যখন নাজুক, বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে রয়েছে বিধিনিষেধএ অবস্থায় এই যন্ত্রের পেছনে বড় অঙ্কের ডলার ব্যয় অযৌক্তি বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইভিএম ১৫০ আসনে ভোট করতে যা কিছু দরকার তার ব্যয়ের একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী কমিশন কাজ করছে। এখন ইভিএমেই ভোট হবে কি না তা নিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
অশোক কুমার বলেন, ‘এটা সত্য যে, ইভিএমে ভোট করতে হলে আমাদের কেনাকাটা বাবদ প্রচুর অর্থ খরচ হবে। তাতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে, ঠিকই।’
এর আগে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন হবে, না হলে সম্ভব হবে নাএমন কথা একাধিকবার বলেছেন।
চলতি বছরের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ইভিএমেই হবে। দলীয় সভায় সরকারপ্রধানের এমন ঘোষণায় রাজনৈতিক মহলে সমালোচনা হয়। পেশাজীবী মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলের আলোচনায় ইভিএম বিরোধিতা হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে মতামত গ্রহণ করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সংলাপ করেন। সেখানে বেশিরভাগ দল ইভিএম নিয়ে আপত্তি তোলে। এক পর্যায়ে ঘোষণা দেওয়া হয় অর্ধেক আসনে ভোট হবে ইভিএমে। বাকি অর্ধেকে ভোট ব্যালটে নেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর নতুন করে সমালোচনা হয় ইভিএমে ভোট কারচুপি করে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় নেওয়ার চক্রান্ত।
এসব দিক তুলে ধরে একজন মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইভিএমে ভোট না করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে অনীহা প্রকাশ করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রীর এই অনীহার কথা আওয়ামী লীগের দুজন সভাপতিম-লীর সদস্যও দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইভিএমে ভোট নিয়ে সরকারের অনীহা রয়েছে এমন তথ্য আমিও পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট নিয়ে নানা মহলের আপত্তি রয়েছে। তার ওপর দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত রিজার্ভও নেই। ইভিএম আমদানিনির্ভর। ভোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে। এই সময়ে এত বড় চাপ না নেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইভিএমে ভোটের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা নেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা পরিস্থিতি চলছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় সরকার পরিচালিত হচ্ছে বলেই এখনো সবকিছু সচল রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভ সাশ্রয় করতে প্রধানমন্ত্রী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছেন।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইভিএমেই ভোট করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তো নেই। আবার অর্ধেক আসনে ব্যালটেও ভোট হওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে রিজার্ভে চাপ কমানোর কৌশলে চলতে হবে সরকারকে। একদিকে রিজার্ভের চাপ কমানো, অন্যদিকে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট করতে যন্ত্র কেনা বাবদ যে অর্থ খরচ হবে তা বিলাস করার মতো। সরকার ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলো ও সুশীল সমাজ থেকে প্রশ্ন উঠবে।
ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে যাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলা হচ্ছে হরহামেশাই। তাই সবদিক রক্ষা করা যাবে ম্যানুয়্যালি ভোট হলে। আবার বিএনপির ইভিএমবিরোধী অপপ্রচারও থেমে যাবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ইভিএম নিয়ে যেকোনো বিশেষ পরিকল্পনা কখনোই ছিল না, তাও সত্যি হয়ে উঠবে মানুষের কাছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন