গ্রাহকের কাছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা পাওনা বাকি পড়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (তিতাস)। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। বারবার চেষ্টা করেও তাদের কাছ থেকে প্রকৃত সময়ে বা রিয়েল টাইমে বিল আদায় করতে পারছে না কোম্পানিটি। আবার প্রভাবশালী হওয়ার কারণে নিয়মানুযায়ী সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। ফলে আর্থিক সংকটে চাপে পড়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিটি।
জানা গেছে, কোনো কোনো গ্রুপ অব কোম্পানির বিলের সংখ্যার হিসেবে ৫০ থেকে একশরও বেশি গ্যাস বিল বকেয়া হয়ে পড়েছে। টাকার অঙ্কে কোনো কোনো কোম্পানির এককভাবে গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে শতকোটি টাকারও বেশি।
তিতাস সূত্র জানিয়েছে, সবশেষ হিসাব অনুযায়ী- তিতাসের বকেয়া গ্যাস বিলের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি গ্রাহকের কাছে প্রায় ২৩০০ কোটি আর সরকারি গ্রাহকের কাছে প্রায় ১৯০০ কোটি টাকা বিল বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে মামলা-মোকাদ্দমাসহ নানা কারণে আদায়যোগ্য নয় এমন বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রাহকদের কাছে সব সময় গড়ে দুই মাসের বিল জমা থাকছে- এমন বিলের পরিমাণ প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে প্রায় ২৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বকেয়া বিল পাবে তিতাস। ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ ইজিসিবির কাছে পাওনা ২৮৫ কোটি ১৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, সার কোম্পানির কাছে পাওনা প্রায় সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি মালিকানাধীন আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে পাওনা প্রায় এক হাজার ১৫১ কোটি চার লাখ ৪৩ হাজার টাকা, মেঘনা সুগার রিফাইনারি কোম্পানির কাছে পাওনা ৪৩ কোটি ৬৩ লাখ সাত হাজার টাকা।
তিতাসের এককভাবে সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিল পাওনা রয়েছে সিনহান গ্রুপের কাছে প্রায় ৭৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। মুন্নু গ্রুপের কাছে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৮০ হাজার, নারায়ণগঞ্জের অন্তিম গ্রুপের কাছে ৩১ কোটি টাকারও বেশি, অ্যাপেক্স টেক্সটাইল গ্রুপের কাছে সাড়ে ২৩ কোটি, লিথুন গ্রুপের কাছে ৩২ কোটি ৯৫ লাখ, ম্যাক পেপারের কাছে বকেয়া ১০ কোটি ৪৪ লাখ, ডেলটা গ্রুপের কাছে ১৫ কোটি ১৮ লাখ, হোসেন পাল্প গ্রুপের কাছে ৩৩ কোটি টাকারও বেশি, ফেমাস গ্রুপের কাছে বকেয়া ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে তিতাসের।
এ ছাড়া এক থেকে ১০ কোটি টাকা বকেয়া আছে- এমন গ্রুপের মধ্যে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের অবন্তি গ্রুপ, আফতাব গ্রুপ, আজাদ রিফাত গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, ক্রিয়েটিভ গ্রুপ, ক্রোনি গ্রুপ, ডিয়ার্ড গ্রুপ, গিভেন্সি গ্রুপ, হারভেস্ট গ্রুপ, ইম্পেরিয়াল গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, জজ ভূঁইয়া গ্রুপ, মাহমুদ গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, মধুমতি সিরামিক গ্রুপ, ম-ল গ্রুপ, মাদার টেক্সটাইল গ্রুপ, পদ্ম গ্রুপ, পাকিজা গ্রুপ, পান্না গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, আর কে গ্রুপ, রহমত গ্রুপ, সিম গ্রুপ, তিথী গ্রুপ, ইউনুস গ্রুপ। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও অনেক শিল্পকারখানার কাছে বকেয়া পাওনা রয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিটির।
তিতাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বড় বড় গ্রুপগুলোর বকেয়া বিল আদায়ে তিতাস কঠোর হতে পারছে না। তিনি বলেন, এসব গ্রুপ নানাভাবে প্রভাবশালী। বকেয়ার জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলেই নানা বাধা চলে আসে। কোনো কোনো গ্রুপের কারখানার ভেতর যাওয়া যায় না, হামলা করে বসে। অনেক গ্রুপ শুধু বকেয়া বিল জমা করে রেখেছে তা নয়, অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করছে। মিটার কারসাজি করে গ্যাস ব্যবহার করছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত গ্যাস বিল আদায়ে শুধু তিতাস নয়; সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে সত্যিকার অর্থে কঠোর বার্তা ও সহযোগিতা থাকতে হবে।
এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লা আমাদের সময়কে বলেন, গত এক বছর ধরে অব্যাহত চেষ্টায় বকেয়া বিলের পরিমাণ কমে আসছে। এখন প্রতিমাসে প্রায় ১২০ শতাংশ বিল আদায় হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বকেয়া বিলের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা হবে। বকেয়া থাকলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বকেয়া গ্যাস বিল আদায়ে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিমাসে বৈঠকে মনিটর করা হচ্ছে। বিল আদায়ে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বকেয়া বিল পড়ে থাকার প্রবণতা কমানো হবে। বকেয়া বিল কমিয়ে আনা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন