অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি আর নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির এই দুঃসময়ে ধেয়ে আসছে আরেকটি দুঃসংবাদ। দাম বাড়ার তালিকায় এবার উঠতে যাচ্ছে সড়ক ও সেতুর টোল। একই সঙ্গে বাড়বে টোলের আওতা। টোল বাড়াতে ২০১৪ সালের নীতিমালা হালনাগাদ করছে সরকার।
পরিবহন খাত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সড়কে চলাচল ও সেতু পারাপারের খরচ বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়বে। ফলে বেড়ে যাবে নিত্যপণ্যের দাম ও বাসের ভাড়াও। এতে সাধারণ মানুষের খরচের বোঝা আরও ভারী হবে।
তবে সরকারি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, আট বছরে টোল না বাড়লেও সড়ক ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তথা ইজারা তিন গুণ বেড়েছে। তা মেটাতে টোল বাড়ানো জরুরি। সড়ক ও সেতুর লেন আগের চেয়ে প্রশস্ত হওয়ায় টোল বাড়ানো যৌক্তিক।
টোল বাড়ানোর আলোচনা গত বছরের জুনে শুরু হলেও গতি পেয়েছে সম্প্রতি। গত বছরের ১১ অক্টোবর ও ২৬ নভেম্বর দুটি সভা হয় মন্ত্রণালয়ে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর সভা করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) টোল বাড়নোর প্রস্তাব করে। 'ভিত্তি টোল ও টোলহার সংশোধন ও যৌক্তিকীকরণ' করতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি কমিটি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে গত ১৭ অক্টোবর সড়ক পরিবহন বিভাগের সভায় নীতিমালা দ্রুত হালনাগাদের তাগিদ দেওয়া হয়। ওই সভায় সচিব বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে টোল আইন-১৯৮৫ এবং টোল নীতিমালা-২০১৪ হালনাগাদ খুবই জরুরি।'
টোল পুনর্নির্ধারণে গঠিত কমিটি কাজ শুরু না করায় সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে আহ্বায়ক করে গত ৬ নভেম্বর কমিটি পুনর্গঠিত হয়। তাঁর অসুস্থতার কারণে গতকাল মঙ্গলবার যুগ্ম সচিব মনীন্দ্র কিশোর মজুমদারের সভাপতিত্বে প্রথম সভা হয়েছে।
সভায় সওজের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সড়ক ও সেতুর লেন প্রশস্ত হওয়ায় পরিবহনে সময় ও জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে।
আগের দ্বিগুণ ট্রিপ দিতে পারছে যানবাহন। বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে সেতুর টোল আদায় হয়। অপারেটরের ফি (ইজারা) আট বছরে তিন গুণ হয়েছে। টোলমুক্ত সেতু প্রশস্ত হলে, সেখানেও টোল আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মহাসড়কের ফ্লাইওভারেও টোল নিতে চায় সওজ।
সওজ নির্মিত এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক, জেলা সড়ক এবং সেতুর টোলহার পুনর্নির্ধারণ করবে কমিটি। সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) টোলহার ভিন্ন। পদ্মা সেতু, যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল তোলে বিবিএ। গত বছরের ১৯ নভেম্বর বেড়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল। বাড়ানোর হার ১৭ শতাংশ বলা হলেও, পণ্যবাহী গাড়িতে টোল বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান সমকালকে জানান, টোল বাড়াতে নীতিমালা হালনাগাদ হবে। টোল বাড়লে পরিবহন খরচ ও ভাড়া বাড়বে, অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে টোল বাড়ানো যৌক্তিক কিনা- প্রশ্নে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, রাজস্ব আয় তো বাড়াতে হবে। সবার জন্য সহনীয় হয়, এমন হারেই টোল বাড়বে।
২০১৪ সালের নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ভিত্তি টোল কিলোমিটারে দুই টাকা। মাঝারি ট্রাকের হিসাবে টোল নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ একটি মাঝারি ট্রাক এক কিলোমিটার চললে দুই টাকা টোল। বাকি যানবাহনের টোল নির্ধারণ করা হয় মাঝারি ট্রাকের অনুপাতে। ট্রেইলারের টোল এর আড়াই গুণ। অর্থাৎ কিলোমিটারে ৫ টাকা। বাসের টোল মাঝারি ট্রাকের ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ কিলোমিটারে এক টাকা ৮০ পয়সা।
সওজ নির্মিত ৭৫১ থেকে ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর ভিত্তি টোল ৪০০ টাকা। অর্থাৎ একটি মাঝারি ট্রাক এই দৈর্ঘ্যের সেতু পার হলে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। হাজার মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুর টোল এর ১২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৫০০ টাকা। এমন দৈর্ঘ্যের সেতুতে বাসের টোল মাঝারি ট্রাকের ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৫০ টাকা।
৫০১ থেকে ৭৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর ভিত্তি টোল ৩০০ টাকা। ২০১ থেকে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর ভিত্তি টোল ২০০ টাকা। সওজের প্রধান প্রকৌশলী জানান, বর্তমানে যেসব সেতু ও সড়কে টোল আদায় করা হচ্ছে, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। যেসব সড়ক চার লেনে এবং এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত হবে, সেগুলোও টোলের আওতায় আসবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় মহাসড়কের ভিত্তি টোল কিলোমিটারে দেড় টাকা। আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কে ভিত্তি টোল যথাক্রমে ১ টাকা ও ৫০ পয়সা। নীতিমালায় এক্সপ্রেসওয়ের উল্লেখ নেই। ২০২১ সালের মহাসড়ক আইনের ২(৫) ধারায় এক্সপ্রেসওয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে টোল আদায়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
গত ১ জুলাই থেকে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সড়কে টোল আদায় করা হয়েছে। তিন সেতুসহ এই রাস্তায় কিলোমিটারে টোল ১০ টাকা। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী কিলোমিটারে টোল ১৮ টাকা ৪০ পয়সা হওয়ার কথা। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও জনগণের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে কম টাকা। সড়ক পরিবহন বিভাগের আরেকটি কমিটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মাঝারি ট্রাকে কিলোমিটারে ২৫ থেকে ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা টোল আদায়ের প্রস্তাব করেছিল।
টোল আদায় ও এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আগামী পাঁচ বছর ৭১৫ কোটি টাকা দিতে হবে বেসরকারি অপারেটর কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনকে (কেইসি)। সওজ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অপারেটরকে ফি দেওয়ার পর সরকার টাকা পাবে সামান্যই। তাই টোল বাড়ানো জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের বদলে এক্সপ্রেসওয়েকে ভিত্তি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সওজ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এক্সপ্রেসওয়ে ছয় লেনের। এক্সপ্রেসওয়ের 'লেভেল অব সার্ভিসের' কারণে ভিত্তি টোল দেড় গুণ বাড়ানো যেতে পারে। বার্ষিক পাঁচ শতাংশ হারে মূল্যস্ম্ফীতি অনুযায়ী টোল বৃদ্ধির গুণিতক ১ দশমিক ৪১। ফলে এক্সপ্রেসওয়ের টোল কিলোমিটারে ৪ টাকা ২৩ পয়সা হওয়া উচিত। একই হারে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলার সড়কের টোল বাড়ানো যেতে পারে। বর্তমানে একটি এক্সপ্রেসওয়ে ও দুটি মহাসড়কে টোল আদায় হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার বলেছেন, মহাসড়কগুলোকে টোলের আওতায় আনা হবে। বর্তমানে তিনটি সড়কে টোল আদায় করা হয়। সড়ক পরিবহন বিভাগের সভার নথি অনুযায়ী, জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর টোল তোলা হবে। চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ককে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত করে টোলের আওতায় আনতে চায় সরকার।
সওজের প্রস্তাবে বলা হয়েছে. নীতিমালা প্রণয়নের সময় সব সেতু ছিল দুই লেনের। অনেকগুলো চার লেনে উন্নীত হয়েছে। নবনির্মিত কালনা সেতু ছয় লেনের। নবনির্মিত বেতাগী ও শীতলক্ষ্যা সেতুও চার লেনের। মেঘনা ও গোমতী সেতু চার লেনের। টোল কত বাড়বে- প্রশ্নে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সমকালকে বলেছেন, টোলহার পুনর্নির্ধারণ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কমিটির সুপারিশের পর মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে বাড়বে টোল।
টোলহার বাড়ানোর বিপক্ষে পরিবহন মালিকরা। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দায় সব কিছুর দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এক বছরে দুইবার বাস ভাড়া বেড়েছে। টোল বাড়লে বাসের ভাড়া বাড়বে। তাতে পরিবহন খাত আরও সংকটে পড়বে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন