রাজধানী ঢাকার হৃদয় বুড়িগঙ্গা। এ নদীর প্রাণ বাঁচাতে নেওয়া হয় একের পর এক প্রকল্প, ঢালা হয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মাঝেমধ্যে চলে উচ্ছেদ, বসে সীমানা পিলার। গেল এক যুগে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচা করেও বদলানো যায়নি বুড়িগঙ্গার চেহারা। পানি হয়েছে আরও কালো। পড়ছে শিল্পকারখানা, ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, গৃহস্থালি, হাটবাজার ও নৌযানের বর্জ্য।
এখানেই শেষ নয়, সেই সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য ধলেশ্বরী নদী হয়ে মিশছে বুড়িগঙ্গায়। এখনও কয়েক ডজন কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে হাজারীবাগে। নদী রক্ষায় সীমানা পিলার নির্মাণ হলেও এর ভেতরেই গড়ে উঠেছে কারখানা ও দোকানপাট। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে অভিযান চালিয়েও দমানো যাচ্ছে না দখলবাজদের। এখনও বেদখল হয়ে আছে শতাধিক একর জায়গা। নদীর জায়গায় কেউ কারখানা, কেউ বসতঘর, আবার মসজিদ বানিয়েও চালাচ্ছেন দখলদারিত্ব। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নেরও অগ্রগতি নেই। এমন প্রেক্ষাপটে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন করছে।
বিশাল খরচও কাজে আসছে না: সরকার ২০০৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প হাতে নেয়। তবে ভুল পরিকল্পনার কারণে এক যুগের বেশি সময় পেরোলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের মেয়াদ। সেই প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকলেও আদতে বুড়িগঙ্গার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রকল্পটি চালু অবস্থায়ই ২০১৬ সালে ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর অবৈধ দখল ঠেকাতে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির খরচ বাড়িয়ে এখন ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে ২০০৪ সালে একটি সমীক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। এর ছয় বছর পর ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ নদী খনন নামে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল যমুনা থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর দূষণ রোধ করা। তবে এখনও যমুনার পানি বুড়িগঙ্গায় গড়ায়নি। বর্তমানে ওই প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ওই চার নদী রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ ওয়াকওয়ে ও সীমানা পিলার নির্মাণসহ নানা কাজে ব্যয় করেছে ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চার বছরমেয়াদি এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়। এ ছাড়া ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধার ও খননকাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
এ ব্যাপারে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ করেছে সরকার। তবে যতগুলো পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে বাদ পড়ে গাজীপুর। ফলে ওই জেলার কারখানা বর্জ্য অন্য নদী হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশছে। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের পর সব পরিকল্পনাই ছিল উচ্ছেদ নিয়ে। দূষণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা হয়নি। উচ্ছেদ অভিযানও ছিল বিতর্কিত। এখনও ১০০ একরের মতো জায়গা বেদখল হয়ে আছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে দখল চললেও তদারকি নেই। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার ড্রেনগুলো দূষণমুক্ত করতে মাত্র ২০০ কোটি টাকাই যথেষ্ট। স্যুয়ারেজ লাইনগুলোতে 'ট্রিটমেন্ট প্লান্ট' বসালে অনেক সুফল মিলবে।
ট্যানারি সরানোর পরও থেমে নেই দূষণ: রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে সরে যাওয়ার পর কেটে গেছে পাঁচ বছর। ট্যানারি সাভারে গেলেও বুড়িগঙ্গার মুক্তি মেলেনি। ওই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত উপকরণের বেশিরভাগ অংশ এখনও বুড়িগঙ্গায় মিশছে। এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের এক যৌথ নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হয়, পরে সেই দূষিত পানির স্রোত বুড়িগঙ্গায় এসে মেশে।
২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর পরিবেশবিষয়ক সংসদীয় কমিটি আশপাশের এলাকার পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলার কারণে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি বন্ধের সুপারিশ করে।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারেরর এক জরিপে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গায় ২৫১ স্যুয়ারেজ লাইন ও ২৩৭ আবর্জনার স্তূপ রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের।
সরেজমিন বেশকিছু স্থানে দেখা গেছে, স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে দিনরাত নদীতে বর্জ্য এসে পড়ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা পশ্চিম ধানমন্ডি হাউজিংয়ে স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি নদীতে যুক্ত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমেও সেই অংশের পানি কালো হয়ে আছে। রাজধানীর শ্যামপুরের কাছাকাছি গেলেই নাকে আসে উৎকট গন্ধ। সামনেই ধলেশ্বরীর গুদারাঘাট। বুড়িগঙ্গার কাছে যতই পা পড়ে, দুর্গন্ধও তত বাড়তে থাকে। ঘাটে গিয়ে দেখা যায় করুণ দশা। নদীর বুকে সরাসরি এসে পড়ছে শ্যামপুর শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য মিশ্রিত পানি। নদীর পানির যতটুকু চোখে পড়ে, মিশমিশে লালচে। নদীর দু'পাশেও আবর্জনার স্তূপ। গতকাল শনিবার বুড়িগঙ্গার কেরানীগঞ্জ ও শ্যামপুর অংশ ঘুরে তিনটি পয়েন্টে ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানার রঙিন বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়তে দেখা যায়।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের গবেষকরা জানিয়েছেন, কেরানীগঞ্জের শতাধিক ওয়াশিং কারখানা থেকে দৈনিক অন্তত ১৮ লাখ লিটারের বেশি বিষাক্ত তরল বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়। শ্যামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক প্রিন্টিং, নিট, ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ৩০ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা নদীতে যাচ্ছে সরাসরি।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, বিশ্বব্যাংক ৭২ রাসায়নিক উপাদানকে বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা শুধু টেক্সটাইল ডায়িং থেকে তৈরি হয়। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্ষতিকর সব উপাদানই পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া বাসাবা?ড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য ভ্যানে করে প্রথমে নদীর পাড়ে নিয়ে স্তূপ করা হয়। পরে রাত কিংবা দিনের সুবিধাজনক সময়ে ওই বর্জ্য শ্রমিকরা টেনে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। পুরান ঢাকার বাদামতলী ও শ্যামবাজারের পাইকারি আড়তের ময়লা আড়তদাররা নদীর পাড়েই ফেলছেন। বিপরীত পাশে ফেলা হচ্ছে গার্মেন্টের বর্জ্য। জিনজিরা ফেরিঘাট থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীরের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায় গৃহস্থালিসহ নানা আবর্জনা সেখানেই ফেলা হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের (এনআরসিসি) এক জরিপে কেরানীগঞ্জে নদীদূষণের ১৬৫ উৎস চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৬৫টি ড্রেন ও পাইপলাইন, যার মাধ্যমে কঠিন, গৃহস্থালি ও রাসায়নিক বর্জ্য নিস্কাশন করা হয়।
এখনও বেদখল ১০০ একর: সীমানা পিলার বসানোর পরও বুড়িগঙ্গার দুই তীরের প্রায় ১০০ একর জায়গা মাটি ভরাট অবস্থায় রয়ে গেছে। দখল করা এসব জমির অধিকাংশই কেরানীগঞ্জ, কালিন্দী, জিনজিরা, শুভাঢ্যা ও কোন্ডা এলাকার। এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচরের কুতুবপুরে নদী ভরাট করা রয়েছে বলে উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের একটি জিআইএসভিত্তিক জরিপে।
গত শুক্রবার কামরাঙ্গীরচরের ধলচরে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করেই বিআইডব্লিউটিএ সেখানে সীমানা পিলার তুলছে। স্থানীয় প্রভাবশালী হাজী মো. মনির হোসেন ওই এলাকায় নদীর একটি অংশ দখল করে কারখানা গড়েছেন। পাশের প্লটের মালিক আবুল হোসেনও নদীর একটি অংশ দখলে নিয়ে বাড়ি তুলেছেন।
আদি বুড়িগঙ্গা নদীর মুখ থেকে কামরাঙ্গীরচরের লোহার সেতু পর্যন্ত নদীর সীমানা চিহ্নিত করে ২৮ পিলার বসানো হয়েছিল, এখন মাত্র ১৩ পিলার দৃশ্যমান। বাকি ১৫ পিলার হাওয়া। গত বৃহস্পতিবার আদি বুড়িগঙ্গা নদীর তীর এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, ভাঙাড়ির দোকানের শাটারের নিচে ঢাকা পড়েছে তিন নম্বর পিলার। এভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর ৩ থেকে ১৭ নম্বর পিলার দেখা যায় না। এসব পিলার ঢেকে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন পল্গাস্টিক কারখানা ও ভাঙাড়ির দোকানসহ নানা অবৈধ স্থাপনা।
এদিকে ভুল স্থানে সীমানা খুঁটি বসেছে দাবি করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার গত বছর এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ খুঁটি বসানো হয়েছে ভুল জায়গায়। এ রকম ৩১২ সীমানা পিলার চিহ্নিত করে তারা।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঢাকা শহরে উৎপাদিত মানববর্জ্য সব চলে যায় আশপাশের চার নদীতে। ঢাকা ওয়াসার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে এমনটি হয়েছে। নদীগুলোর দখল করা জমির বেশিরভাগ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, তবে দায়ীদের আইনের আওতায় না আনায় দূষণ বন্ধ করা যায়নি।
বুড়িগঙ্গা রক্ষায় আদালতের রায় বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, আইনিভাবে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আদালতের রায় বাস্তবায়নে বাধা। এমন হলে নদী দখলমুক্ত হবে না। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গাকে যমুনার সঙ্গে যুক্ত করা গেলে ঢাকার চারপাশের নদীপথে পণ্য বা জনপরিবহন সম্ভব হবে। অথচ এগুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়।
এসব প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'নদী, পানিদূষণবিষয়ক সব আইন আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে পাস হয়েছে। বুড়িগঙ্গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দখল ও দূষণরোধে সরকার কাজ করছে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন