২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার অনুগত ও বিশ্বস্ততার সাথে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, গুম-খুন অব্যাহত রাখা বেনজির আহমদ পুলিশ প্রধানের পদ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বিদায়ের আগে তাঁর অপকর্ম গুলোর হিসাব-নিকাশ সামনে উঠে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বেনজীর আহমেদের মতো ভয়ঙ্কর খুনী, নৈতিক স্খলনে দুষ্ট কোনো ব্যক্তি কখনও আইজি হয়নি বলেই মনে করেন পুলিশ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই তাকে বানানো হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন বেনজীর আহমদ। ঢাকা মহানগর পুলিশের আইজি থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে রাতের আধারে গণহত্যা বেনজীর আহমদের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল। এই গণহত্যায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেনজীর তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু গণহত্যাই নয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে তামাশার আয়োজনের আগে গড়ে উঠা আন্দোলন দমনের নামে চালানো কথিত ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনা গুলোরও মূল নায়ক ছিলেন এই বেনজীর আহমদ। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম সহযোগী হিসাবেই ২০১৫ সালের এপ্রিলে বেনজীর আহমদকে র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা।
২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল পুলিশ মহাপরিদর্শক হবার পর চলতি বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পদে আসীন থেকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার অপরাজনীতির নীলনকশা বাস্তবায়নে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন নি।
এসব করেও পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে তার চাকরীর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। কারণ, গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বেনজীরসহ র্যাবের ছয় শীর্ষ কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে তার মেয়াদ বাড়ানোর সাহস করেননি ভোট চুরি করে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা।
শাপলা চত্বরে গণহত্যা:
২০১৩ সালের ৫ই মে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের দোসর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর) যৌথভাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে। মধ্যরাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল সেদিন। এই গণহত্যায় যৌথবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনীও যোগ দিয়েছিল অস্ত্র হাতে। এই গণহত্যার দিনটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের এক বিশেষ মাইল ফলক হিসাবেও চিহ্নিত হয়ে আছে ইতিহাসে।
গণহারে আলেম হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা মহাগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ।
৫ই মে’র গণহত্যায় কত মানুষ নিহত হয়েছিলেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনো নেই। তবে ইতিহাস একদিন সেই রাতে শাহাদাতবরণকারী আলেম, মাদ্রাসা ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকদের নামের তালিকা অবশ্যই খুঁজে বের করবে। এই গণহত্যার বিচারও একদিন হয়ত হবে দেশের মাটিতেই।
ওই রাতের নৃশংস হামলায় যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তাদেরকেও পরবর্তীতে নির্যাতনর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এছাড়া শাপলা চত্বর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন মহাসচিব ও পরবর্তীতে আমীরের দায়িত্বপালনকারী মরহুম আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মত আলেমকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল বেনজীর আহমদের নির্দেশেই। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি।
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আহতদের অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বেনজীর আহমেদের নির্দেশে বিভিন্ন থানার পুলিশ ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়েছিল। আহত অবস্থায় তাদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও ঢাকায় তখন অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে গুম এবং ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়। এই গুম-খুনের পুরস্কার হিসাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার তাকে র্যাবের মহাপরিচালক ও পরবর্তীতে পুলিশের আইজি হিসাবে পদোন্নতি দেয়।
আলেমদের হাড্ডি গুড়া করার হুমকি:
শেখ মুজিবের মূর্তি স্থাপনের বিরোধীতা করায় আলেমদের হাড্ডি গুড়া করে দেয়ার হুমকি দিয়েও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন এই গোপালী পুলিশ কর্মকর্তা।
দেশের আনাচে-কানাচে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপনের পক্ষে সাফাই গাইতে ২০২০ সালের ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা শেরেবাংলা নগরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরামের সদস্যদের এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতোই দলীয় কায়দায় বক্তব্য দিয়েছিলেন বেনজীর। অদ্ভূত ভঙ্গিমায় বক্তব্যের সময় ধর্মীয় বক্তাদর নাম উচ্চারণ করে নিজের পান্ডিত্য জাহির করে আলেমদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে ভুল তথ্য দেয়াসহ ইসলামপন্থী নেতাদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করেছিলেন তিনি। ওই সমাবেশে বেনজির আহমদসহ অন্যান্য সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় বক্তব্যের কপি ভার্সন।
সেই সমাবেশে বেনজীর আহমদের বক্তব্যের ১৬ মিনিটের একটি ভিডিও পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
ওই সমাবেশে বেনজীর আহমেদ আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকিসহ নানা ব্যাঙ্গাত্মক কটুবাক্যে ও বিষোদগার করেছিলেন। আলেম-ওলামাদের শাসিয়ে চুপ থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। নতুবা হাড্ডি গুড়া করে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহানের মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলাকে রাষ্ট্র, সংবিধান ও দেশের মানুষের ওপর হামলা বলে মন্তব্য করে বেনজির বলেছিলেন, ‘এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রি-এশিউর করতে চাই, রাষ্ট্র অবশ্যই তাদেরকে (মূর্তির বিরোধিতাকারীদের) কঠোর হস্তে মোকাবেলা করবে।’
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির বিরোধীতা মানেই রাষ্ট্র-বিরোধী কাজ উল্লেখ করে আলেমদের হুমকি দিয়ে বেনজীর বলেছিলেন, 'রাষ্ট্র মহাপরাক্রমশালী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। রাষ্ট্র এটা বরদাশত করবে না'।
আলেমদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন, 'আজকে আমরা দেখি অনেকে উল্লম্ফন করেন। মাসল ফ্লেক্সিং করেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে মাসল ফ্লেক্সিং? গো ব্যাক এন্ড সিট ব্যাক। এন্ড ট্রাই টু রিয়ালাইজ হোয়াট ইউ আর ডুইং'।
এই বেনজীর আহমেদ যখন র্যাবের প্রধান ছিলেন তখন শেখ হাসিনার নির্দেশে ভিন্নমতকে দমন করতে অনেক নিরীহ মানুষকে গুম ও খুন করেছেন।
বোট ক্লাব ও পরীমণি কাণ্ড:
২০২১ সালের জুন মাসে ঢাকাই সিনেমার বিতর্কিত অভিনেত্রী পরীমণিকে মধ্যরাতে বেনজীর আহমেদের কর্তৃত্বাধীন বোটক্লাবে নিয়ে হত্যা ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল। সেই ঘটনায় তোলপাড় হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। বোটক্লাবে নির্যাতনের শিকার পরিমণি পরে বেনজীর আহমেদেক 'চলচ্চিত্রের বন্ধু' সম্বোধন করে ফেসবুক লাইভে পুরো ঘটনা তুলে ধরেছিলেন।
সাভারে তুরাগ নদের তীরে বিরুলিয়ায় ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ক্লাবটি। বেনজীরের নেতৃত্বেই এই জমিটি দখলে নিয়ে বোট ক্লাব গড়ে তোলার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিমণি বলেছিলেন, আমরা জানতাম না যে ওটা বোট ক্লাব। পরে তারা বেনজীর ভাইয়ের (আইজিপি বেনজীর আহমেদ) কথা বলে (আমাদেরকে নিয়ে যায়)।
পরবর্তীতে আওয়ামী সংসদে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ প্রশ্ন তোলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সরকারের অনুমতি নিয়ে এই ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কি না।
তিনি বলেন, আমার জানা নাই, ৫০ বছরের ইতিহাসে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ ধরণের কোনো ক্লাবে পুলিশের প্রধান সভাপতির দায়িত্ব বা এই রকম ক্লাব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বোট ক্লাব যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যহারের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছিল সেটা প্রকাশ পেয়েছিল তখনই।
গুম-ক্রসফায়ারে কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বেনজীর:
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের ছয়জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই তালিকায় বেনজীর আহমেদের নামও রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে র্যাব প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলো বাতিলের হয়ে যায়।
একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বেনজীর আহমেদ ও র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ র্যাবের আরও চারজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার আমেরিকানায় সম্পদ থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে গুম-খুন সহ নানা অভিযোগ তুলে ধরছিলো। কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল আন্তর্জাতিক মহলে।
আর এসব হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগই বেনজীর আহমেদের সরাসরি নির্দেশনা ও তত্ত্ববধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পুলিশ ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত এবং টিকিয়ে রাখতে নিরন্তর অপচেষ্টায় ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মূলত: কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন রাজনৈতিক কর্মীর মত। বিরোধী দলকে দমনে সিদ্ধহস্ত এই পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে অসংখ্য বিরোধী দলীয় কর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম করা হয়েছে। ভিকটিমদের পরিবার গুলো একদিন ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন