রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত এবং অনিয়ম বন্ধে সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সাইনবোর্ডে লাইসেন্স নম্বর যুক্ত এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে কিউআর কোডসহ সেটি ডিসপ্লে (প্রদর্শন) বাধ্যতামূলক। না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
তবে সরকারের এমন নির্দেশনার এক মাস পার হতে চললেও কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রই তা বাস্তবায়ন করেনি। উলটো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছেমতো কার্যক্রম চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইতোপূর্বে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক বন্ধ বা সিলগালা করে দেওয়া অধিকাংশ অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ফের নামে-বেনামে জমজমাট চিকিৎসা ব্যাণিজ্যে মেতে উঠছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীসহ দেশের একাধিক বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবৈধ ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত তিন মাস ধরে কয়েক দফায় অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এ সময় দুই হাজারের বেশি চিকিৎসাকেন্দ্রকে সিলগালা, সাময়িক বন্ধ ও অর্থদণ্ড দিয়েছে। এরপরও অনিয়ম বন্ধ না হওয়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার সদ্য সাবেক পরিচালক ডা. মো. বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে প্রত্যেক বেসরকারি স্বাস্থকেন্দ্রের সাইনবোর্ডে লাইসেন্স নম্বর, মেয়াদোত্তীর্ণের সময় লেখা বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে সরকারি নির্দেশনার পর তা কোনোভাবেই মানা হচ্ছে না। সারা দেশে ব্যঙ্গের ছাতার মতো নামে-বেনামে গড়ে ওঠা অধিকাংশ বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠান সেবার নামে আগের মতোই রোগীদের পকেট কাটছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারি না থাকায় এমনটা হচ্ছে। এই সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসা ব্যবসায়ীরা সেবাদানের মতো মৌলিক অধিকার পূরণে জনগণকে ঠকাচ্ছে। এই বাণিজ্যিক মনোভাব বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে অনিয়মের লাগাম টানা চ্যালেঞ্জ হবে।
এদিকে গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর নামিদামি একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করে কোথাও নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার উপপরিচালক ডা. শফিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈধ-অবৈধ চিহ্নিত করতেই লাইসেন্স নম্বর, নবায়ন, মেয়াদের সময় লেখার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রত্যেক বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও জেলা সিভিল সার্জনকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। বাস্তবায়ন না হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অতিদ্রুত কঠোর অবস্থানে যাব। এ জন্য আমরা আরেকটা সভা করব। তবে অভিযান বা নির্দেশনা পরবর্তী পরিস্থিতি দেখভালে অধিদপ্তরের জনবল সংকট রয়েছে। এরপরও নিয়ম না মানলে কাওকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগে বৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা এক হাজার ৪৪৩টি। এরমধ্যে জেলায় রয়েছে ২৮৬টি। প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় রাজশাহী নগরীতে ১৩০টি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্স না থাকায় গত মে এবং জুন মাসে ৫৩টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু গত এক সপ্তাহ রাজশাহীর অন্তত ৫০ ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ঘুরে কোনো প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে লাইসেন্স নম্বর, নবায়ন ও মেয়াদ লেখা দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অমান্য করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
যন্ত্রপাতি ও লোকবলের ঘাটতি ও রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে দুই মাস আগে খুলনা মহানগরীতে অনিবন্ধিত ৩৯টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু হয়েছে। সাইনবোর্ডেও অধিদপ্তরের সনদ, মেয়াদ কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘মহানগরীতে ২২৯টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যারমধ্যে ক্লিনিক রয়েছে ১৩২টি। বাকিগুলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অনিবন্ধিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল ৩৯টি। সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা আবারও অভিযান চালিয়ে সবগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, নগর ও জেলা মিলে ৫৭৬টি অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র আছে। এর বাইরে আরও প্রায় হাজারখানেক বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই লাইসেন্স নম্বর উল্লেখ করছে না।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের নির্দেশনার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে সাইনবোর্ড লাগানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিদর্শন করা হবে।’
প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনভুক্ত প্রায় ১১ হাজার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের সবার বৈধ কাগজপত্র আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সাইনবোর্ডে উল্লেখের বিষয়ে সবাইকে অবগত করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবারও জানিয়ে দেওয়া হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি চিকিৎসাখাত নিয়ে টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে স্বাস্থ্য বিভাগ এই নির্দেশনা দিয়েছে। যা ন্যূনতমভাবেও পালন হচ্ছে না। খাতটিতে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সংশ্লিষ্টরা নিয়ন্ত্রণহীনতাকে বাস্তবতা ধরে নিয়েছে। এমনকি যাদের লাইসেন্স আছে সেটি প্রদর্শন করলে স্বচ্ছতা বাড়বে সে উপলব্ধিটাও তাদের মধ্যে নেই। এখন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এমন পদক্ষেপে নিতে হবে, যাতে নিজেদের স্বার্থেই বিষয়গুলো মান্য করে। একাধিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পুরো স্বাস্থ্যখাতকে সংস্কার করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন