দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশয় ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ব্যবস্থাপনা গ্রহণের তাগিদ দিয়ে তারা বলেছেন, এলএনজি’র ওপর অধিকতর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে আরো আর্থিক সংকটে ফেলবে। এ সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে দেশীয় গ্যাস মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, উপর মহল বা নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে অনেকেই বলেন, দেশে গ্যাস নেই। যেটুকু আছে তা উত্তোলনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করেই চলতে হবে। জনগণের সামনে এসব কথা বলার আগে আরেকটু দায়িত্বশীল হতে হবে। বদরুল ইমাম বলেন, সরকারি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই বলেন, মিয়ানমার গত ১০ বছরে গ্যাস পায়নি। যা পাওয়ার অনেক আগে পেয়েছে। কিন্তু একথা অসত্য, মিয়ানমার গত দু-তিন বছর আগেও গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ যদি বলে আমাদের সমুদ্রের অবস্থা আমরা জানি না। এটা ভুল কথা। আমাদের রিজার্ভ ও রিসোর্স নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। উপর মহল বা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে বলেন, বাংলাদেশে গ্যাস নেই। তারা জিয়োলোজিস্টের উদাহরণ দিয়ে বলেন, মাটির নিচে গ্যাস নেই। তবে এটা বলা উচিত না। তারচেয়ে বরং বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত বিজ্ঞানভিত্তিক অ্যাসিসমেন্ট দেখে তাদের কথা বলা উচিত।
বদরুল ইমাম বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন মাত্র ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তারা কূপ খনন করেছে ১৭০টি। অথচ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের দেশে কূপ খননের সংখ্যা মাত্র ৯৮টি। মিয়ানমার পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না, এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাগরে ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র আছে। অথচ আমরা এখনো উত্তোলনে যেতে পারিনি। অন্যদিকে মিয়ানমার শিগগিরই সাগরে গ্যাস উত্তোলন শুরু করতে পারে। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে নিজেদের সম্পদ নিজেরাই উত্তোলন করবো। কিন্তু আমরা জাতির পিতার নীতি থেকে সরে এসেছি।
তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, আজকে আমরা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে সংকটটা দেখতে পাচ্ছি এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে পুরো অর্থনৈতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে, এটা খুব আকস্মিক বা হঠাৎ করেই হয়েছে বিষয়টা এমন না। যে সংকট এখন তৈরি হয়েছে এটা তৈরি করার মতোই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিদ্যুৎ খাতে আমাদের প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে নাগরিক থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে এই ভর্তুকির সুবিধা কারা পাচ্ছে? গত ১১ বছরে এ রকম টাকা দেওয়া হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ১২টা এ রকম কোম্পানিকে টাকা দেয়া হচ্ছে।
দেশ এখন খাদের কিনারে বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা সংকটের মধ্যে আছি। আরো ভয়াবহ সংকটের দিকে যাব। জানি না এর পরিণতি কী হবে। তিনি বলেন, দেশে এখন চলছে ভাই-ব্রাদার তন্ত্র। সেই সঙ্গে আছে মতলববাজির উন্নয়ন। যার মধ্যে আমরা নিপতিত হয়েছি। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এলএনজি’র উপর অধিকতর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে আর্থিক সংকটে ফেলবে। এ সংকট সমাধানের একটিই উপায়, সেটি হলো দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গ্যাস সম্পদমূল্যায়ন সংস্থাসমূহ একমত পোষণ করেন যে বাংলাদেশে এখনও অনাবিষ্কৃত গ্যাস পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, জ্বালানির সংকট আমাদের অনিবার্য ছিল না। এটা অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। একসময় বলা হয়েছিল বাংলাদেশ গ্যাসের ওপরে ভাসছে। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল, গ্যাসটা রপ্তানি করা। এরপর বলা হলো আমাদের গ্যাস নাই এবং পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম। যদিও সরকার ২০১০ সালে নরওয়ে আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে যেই সনদটা করেছিল সেখানে শুধু স্থলভাগেই ৩৪ থেকে ৩৮টি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, ২০১২ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর সেখানেও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। এর পরও বলা শুরু করল যে গ্যাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের পুরো ব্যবস্থাটাকে আমদানিনির্ভর করে তোলা।
পাওয়ার অ্যান্ড অ্যানার্জি সম্পাদক মোল্লা আমজাদ বলেন, আপনারা যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তারা অনেক সময় মিডিয়াকে একটা বিতর্কের উপকরণ তৈরি করে দেন। এই মাসে দুটি অনুষ্ঠানে ‘গ্যাস নেই, এলএনজিই ভরসা’- এ ধরনের বক্তব্য এসেছে। আমরা যারা মিডিয়ার সঙ্গে আছি, আপনাদের কাছে বক্তব্যের বাইরেও আরও কিছু প্রত্যাশা করি। এ ধরনের বক্তব্যের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিলে ভালো। মোল্লা আমজাদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলেও বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে পারতো। সরকারের উচিত প্রতি বছর বাজেটে এক বিলিয়ন ডলার বাজেট করে অন্তত ১০টি কুপ খনন করা। আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘণফুটে নেমে আসবে। কিন্তু চাহিদা হবে তখন ৩ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তখন এলএনজি আমদানিনির্ভরতা আরও বাড়বে। তবে তার আগেই আমাদের গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগী হতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন