জ্বালানি তেলের দাম কমাতে শুল্ক কমানোর চিন্তা করছে সরকার। শুল্ক কতটা কমানো যেতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও পেট্রোবাংলাকে নিয়ে পর্যালোচনা করছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। শিগগির জ্বালানি বিভাগ থেকে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব অর্থ বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো হবে বলে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এরই মধ্যে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-সংবলিত একটি নির্দেশনা দিয়েছে। সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
সরকারি মহলের একটি অংশ ধারণা করছে, দাম একবারে এতটা বাড়ানো ঠিক হয়নি। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ও এত বেশি হারে দাম বাড়ানোর পক্ষে ছিল না। এমন প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানোর চিন্তা চলছে। এ জন্য একাধিক বিকল্প রেখে এগোচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাব তৈরি করতে এরই মধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আমদানি খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কতটা কমিয়ে কীভাবে তা মানুষের আয়ত্তে রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলা হয়েছে।
তবে শুল্ক প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো তারা পায়নি বলে জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, শুল্ক কমানোর কোনো নোটিশ এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ে আসেনি। এলে পর্যালোাচনা করা হবে।
সরকার কর্তৃক তেল আমদানিতে গড়ে ৩২ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাট রয়েছে। প্রতি লিটার তেলে বর্তমানে ট্যাক্স রয়েছে ৩৬ টাকা। শুল্ক প্রত্যাহার হলে তেলের দাম ৩৬ টাকা পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
দাম কমানোর বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, সরকার শুল্ক প্রত্যাহারের মাধ্যমে যদি তেলের দাম কমায়, সেটা অবশ্যই জনগণের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সার্বিকভাবে সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব কৃষি ও পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দাম কমানোর বিষয়ে এখনো দাপ্তরিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে দাম কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলে আমরা পর্যালোচনা করব।’
শুল্ক কমানোর বিষয়ে তাদের কোনো এখতিয়ার নেই জানিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। যদি শুল্ক কমানো হয়, তাহলে দাম অবশ্যই কমানো হবে।’ বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজিতে নির্ভর করেছিল। এখন রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উন্নত দেশগুলো এই এলএনজি কিনছে। তাদের সঙ্গে দামে পেরে উঠছে না ঢাকা। গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারের যে অবস্থা তাতে এখন সরকারকে এলএনজি কিনতে হলে প্রায় সাত গুণ দাম দিতে হবে।
এই অবস্থায় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে লিটারপ্রতি করা হয়েছে ১১৪ টাকা। আগে এর দাম ছিল ৮০ টাকা। এতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৬ টাকা লিটারের পেট্রলের নতুন দাম ১৩০ টাকা। অন্যদিকে ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৯ টাকার অকটেনের লিটার ১৩৫ টাকা।
সম্প্রতি বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে এসেছে। যদিও কম দামের তেল এখন পর্যন্ত কেনেনি সরকার। দাম কমার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং বিপিসি কিনতে সক্ষম হলে শুল্ক না কমিয়েও দাম কমানো হতে পারে। আর তেলের দাম না কমলে শুল্ক কমিয়ে লাগাম টানা হতে পারে।
জ্বালানি তেলে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাবদ প্রায় ৩৭ শতাংশ কর দিতে হয়। জ্বালানি বিভাগের এক হিসাবে, বর্তমানে ১১৪ টাকা প্রতি লিটার ডিজেলের মধ্যে ১৬ টাকা ১৪ পয়সা ভ্যাট পরিশোধ করছেন ক্রেতারা। আয়কর বাবদ প্রতি লিটারে আরও ১৮ টাকা কর দিতে হয়।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের রাজস্ব চাহিদা রয়েছে। সব ক্ষেত্রে ছাড় দিতে গেলে রাজস্ব সংগ্রহ কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য ব্যয়ের ওপর চাপ তৈরি হবে। এ জন্য ভ্যাট ও আয়করের যেকোনো একটি থেকে জনগণকে অব্যাহতি দিলে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা হলেও কমবে।
জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হেলাল উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে আয়কর ও ভ্যাটের নতুন হার ঠিক করা হয়েছে। শিগগির পুনর্নির্ধারিত হার কার্যকরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনবিআরকে অনুরোধ করা হবে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে জ্বালানি বিভাগ আয়কর ও ভ্যাট পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তা গ্রহণ করেনি এনবিআর। ওই সময় আয়কর ও ভ্যাট শতাংশের পরিবর্তে নির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করে জ্বালানি বিভাগ। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম সব সময় ওঠানামা করে। দাম বাড়লে আয়কর ও ভ্যাট বাবদ খরচ বেড়ে যায়। এবারও একই ধরনের প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া দেশে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমদানি খরচ কমছে না। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে চাচ্ছে। তাই জ্বালানি তেলের দাম কমানো বা কর ও শুল্কহার পুনর্নির্ধারণ- সবকিছুই নির্ভর করছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর।
এদিকে গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, জ্বালানি তেল থেকে আয়কর ও ভ্যাট কমানো বা প্রত্যাহার সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়। এখানে এনবিআরের কোনো ভূমিকা নেই।
এ বিষয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তেলের দাম সমন্বয়ের পাশাপাশি সংকট মোকাবেলায় সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন