সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সর্বত্র মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ভূমিকা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। হঠাৎ করে কেন রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো সে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। সেই প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বিপিসির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দাম বাড়ানোর পরও ডিজেলে প্রতি লিটারে ৬ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে বিপিসিকে তবে পেট্রল ও অকটেনে বিপিসি এখন লাভ করছে। বর্তমান অবস্থায় যদি বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং ডলার দর যদি ব্যাংক নির্ধারিত দামে থাকে তবে বিপিসি এখন সামগ্রিক জ্বালানি তেলে আগস্ট মাসেই ২০৫ কোটি টাকা লাভ করবে।
এদিকে বিপিসি সাংবাদিকদের সামনে তাদের আর্থিক চিত্র তুলে ধরে। লিখিত বক্তব্যটি পড়েন বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ। উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন) মো. খালিদ আহম্মেদ, পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া। চেয়ারম্যান লিখিত বক্তব্যে বলেন, বিপিসি দীর্ঘদিন লোকসানে থাকার পর ২০১৪-২০১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত লাভে ছিল। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা ছিল প্রায় ৪২ হাজার ৯৯২ দশমিক ৫১ কোটি
advertisement
টাকা। তবে একই সময়ে বিভিন্ন প্রকল্প ব্যয় এবং সরকারকে লভ্যাংশ প্রদান এবং এনবিআরের বকেয়া পরিশোধ বাবদ খরচ হয়েছে ২০ হাজার ১৮৮ দশমিক ৭১ কোটি টাকা। ২২ হাজার ৮০৩ দশমিক ৮০ কোটি টাকা বিপিসির হাতে ছিল। তবে বৈশি^ক পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বিপিসির আবারও লোকসান শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রভিশনাল হিসাব অনুযায়ী বিপিসির লোকসান হয় প্রায় ৫ হাজার ৯১০ দশমিক ৬৯ কোটি টাকা।
চেয়ারম্যান লিখিত বক্তেব্যে বলেন, জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্যের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রয় মূল্যের সামঞ্জস্যপূর্ণ না থাকার করণে বিপিপি ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর পর্যন্ত অব্যাহত লোকসান গুনতে হয়েছে। সেই লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৩ হাজার ০০৫ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময় সরকারকে জ্বালানি খাতে ভর্তুকির বিপরীতে বিপিসিকে বিভিন্ন সময়ে ৪৪ হাজার ৮৭৭ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা প্রদান করে। বিপিসি বলছে ওই সময় সংস্থাটির প্রায় ৮ হাজার ১২৭ দশমিক ৬৯ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। যা পরে বিপিসির মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।
বিপিসির চেয়াম্যান লিখিত বক্তব্যে বলছে বৈশি^ক পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বিপিসির প্রতি লিটার ডিজেলে ৩ টাকা থেকে শুরু করে ৫৪ দশমিক ৪৭ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হয়েছে। বিপিসি সামগ্রিক জ্বালানি তেল বিক্রয়ে জানুয়ারিতে ১৭৪ দশমিক ২৮ কোটি টাকা, মার্চে ১২১৫ দশমিক ০৯ কোটি টাকা, এপ্রিলে ৯৬৬ দশমিক ৭১ কোটি টাকা, মে মাসে ১৫১১ দশমিক ০৯ কোটি টাকা, জুনে ২৫২৫ দশমিক ৩১ কোটি টাকা এবং জুলাই মাসে ১৬২২ দশমিক শূন্য দশমিক ৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। সর্বমোট গত ৭ মাসে আট হাজার ১৪ দশমিক ৫১ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
চেয়ারম্যান তার লিখিত বক্তেব্যে আরও বলেন দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বিপিসি ইস্ট্রার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল ইউনিট-২), সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন, জেট এ-১ পাইপলাইন, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনসহ ১১টি প্রকল্প মোট প্রায় ৩৪ হাজার ২৬১ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে সরকার ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পটি (প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ১৯ হাজার ৪০৪ দশমিক ৭২ কোটি টাকা) বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিপিসির মুনাফার একটি অংশ প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করা হয়েছে। বিপিসির এফডিআরগুলোর প্রায় সবই বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ছিল। তিনি বলেন ব্যাংকে এফডিআর নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে খবর বেরিয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। তিনি বলেন জ্বালানি তেলের পেমেন্ট নিশ্চিত রাখার জন্য বিপিসিকে দুই মাসের জ¦ালানি তেলের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ চলতি মূলধনে রাখতে হয়। যার মধ্যে ২ বৃদ্ধিসহ বিবেচনা করতে হয়। চলতি মূলধন হিসেবে রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে বিপিসির চলতি মূলধনও বৃদ্ধি করতে হয়। ২০২০-২১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য তুলনামূলকভাবে সহনশীল ছিল। তিনি বলেন, বিপিসি জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রয় ও অন্যান্য খাতে মাসিক গড় জমা ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছিল। অপরদিকে জুন ২০২২ মাসে বিপিসির পেমেন্ট ছিল ৭ হাজার ১৭১ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুলাই মাসে পেমেন্ট ছিল ১০ হাজার ৩১২ দশতিক ৭৬ কোটি টাকা এবং আগস্ট মাসে পেমেন্ট প্রক্ষেপণ ৯ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে বিপিসির চলতি মূলধন প্রয়োজন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন এফডিআর করা অর্থ তেল আমদানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের প্রয়োজনে নগদায়ন করা হয়। বিপিসির চেয়াম্যান বলেন, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিপিসির সর্বমোট তহবিল আছে ১৯ হাজার ৮৮২ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা।
এদিকে এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন দেশে বর্তমানে ৩০ দিনের ডিজেল মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ থেকে ১৯ দিনের অকটেন, ১৮ দিনের পেট্রল এবং ৩২ দিনের জেট ফুয়েল রয়েছে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান, তবে জ্বালানি তেল নিয়ে কোনো সংকট নেই। ভবিষ্যতে যে জ্বালানি তেল প্রয়োজন সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন