সমঝোতার মাধ্যমে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা প্রথম দেশের প্রধানতম দুই সমুদ্রবন্দর ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। বন্দরের পাশাপাশি দেশের সকল রাস্তায় ইন্ডিয়ান পণ্য অবাধ যাতায়াতের সুযোগ করে দিয়েছে একতরফাভাবে। দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে বন্দর ও দেশের সকল রাস্তা সমর্পণ করেছিলেন শেখ হাসিনা দিল্লীতে গিয়ে। সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির মাধ্যমে সারা দেশই যেন শেখ হাসিনা দিয়ে এসেছেন ভারতের অধীনে।
ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার প্রথম বিদেশ সফর ছিল দিল্লীতে। ২০১০ সালে ১২ জানুয়ারী দিল্লী সফরে গিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তির সম্মতি স্মারকে স্বাক্ষর করেন। ১/১১-এর জরুরী আইনের সময়ে সেনা প্রধান মঈনের সাথে ইন্ডিয়ার সমঝোতায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়। এর প্রতিদান দিতেই ২০১০ সালে দিল্লীতে গিয়ে স্বাক্ষর করে আসেন দেশ বিরোধী চুক্তির সমঝোতা স্মারকে। স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে অনেক গুলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দিল্লী ও ঢাকার মধ্যে। মূলত: এই চুক্তি গুলোর মাধ্যমে একতরফাভাবে দেশের বন্দর ও রাস্তা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় ইন্ডিয়াকে। সমঝোতা স্মারকসহ ধারাবাহিক এই চুক্তি গুলোর কপি এসেছে আমার দেশ-এর হাতে।
উল্লেখ্য, ইন্ডিয়ার সাথে গোপন এই চুক্তি গুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার কখনো প্রকাশ করেনি। এমন কি বিদেশের সাথে চুক্তির পর সংসদে উত্থাপনের বিধান থাকলেও সেটা মানা হয়নি। আমার দেশ এই বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব বিপন্নকারী চুক্তি গুলোর বিস্তারিত পাঠকের সামনে তোলে ধরার আয়োজন করেছে। এছাড়া আমার দেশ ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেইসবুক পেইজে পত্রিকাটির সম্পাদক বন্দর ও রাস্তা ব্যবহারের চুক্তির শর্ত গুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেছেন আলোচনার মাধ্যমে। কেউ চাইলে ইউটিউব চ্যানেল অথবা ফেইসবুক পেইজে প্রবেশ করে বিস্তারিত আলোচনা শুনতে পারবেন। আগামী রবিবার দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে চুক্তির শর্ত গুলো নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন আমার দেশ সম্পাদক। এখানে (৭ আগস্ট) অনুষ্ঠিত লাইভে প্রকাশিত চুক্তির শর্ত গুলো আমার দেশ-এর পাঠকদের জন্য বিস্তারিত উপস্থাপন করা হল-
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর হয়ে ইন্ডিয়ান পণ্য সেদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাবে। দেশ বিরোধী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আবদুস সামাদ। অপর দিকে ইন্ডিয়ার নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব গোপাল কৃষ্ণ স্বাক্ষর করেন চুক্তিতে।
চুক্তি অনুযায়ী ইন্ডিয়ান ট্রানজিটের পণ্য বন্দরে পৌছার পর কনটেইনারে কী এসেছে সেটা পরীক্ষা করতে পারবে না বাংলাদেশের কোন কর্তৃপক্ষ। বন্দরে কোন পণ্যবাহী জাহাজ এসে পৌছার পর কনটেইনারে কি রয়েছে, সেটা নিয়মিত পরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু, ইন্ডিয়া থেকে ট্রানজিটের জন্য আসা পণ্য নিয়মিত পরীক্ষার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে চুক্তির শর্তে। পরীক্ষা ছাড়াই এ পণ্য বাংলাদেশের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ইন্ডিয়ার অন্য প্রান্তে। চট্টগ্রাম ও খুলনার বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাস্তা দিয়ে ইন্ডিয়া এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কি নিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখার বা জানার কোন এখতিয়ার বাংলাদেশের কোন কর্তৃপক্ষের নাই। চুক্তি অনুযায়ী ইন্ডিয়ার পশ্চিম প্রান্ত থেকে উত্তর পূর্বের ৭টি রাজ্যের সাথে যোগাযোগের মূল পথ হল বাংলাদেশ।
২০১৫ সালের ৬ জুন ইন্ডিয়ার সাথে সম্পাদিত চুক্তির আর্টিকেল ৪(১)-এর শর্ত অনুযায়ী কাস্টম কর্তৃপক্ষের নিয়মিত রুটিন চেকের আওতামুক্ত থাকবে ইন্ডিয়ান পণ্য। অর্থাৎ বন্দরে পণ্য পৌছার পর শুল্ক বা কাস্টম কর্তৃপক্ষের নিয়মিত রুটিন তদারকি অনুযায়ী পণ্য পরীক্ষা করা হয়। চুক্তির এ শর্ত অনুযায়ী ইন্ডিয়ান পণ্য থাকবে স্পর্শহীন।
চুক্তির আর্টিকেল ৪(৩)-এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার রয়েছে বন্দর ও রাস্তায় পণ্য পরীক্ষা করে দেখার। কিন্তু ইন্ডিয়ান ট্রানজিটের পণ্য কাস্টম কর্তৃপক্ষ স্পর্শ করতে পারবে না।
আর্টিকেল ৪(৪)-এর শর্ত অনুযায়ী যাতায়াত মনিটর করার নিমিত্তে পণ্য ট্র্যাকিং করার জন্য কোন রকমের ই-লক এবং ই-সীল লাগাতে পারবে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চুক্তির আর্টিকেল ৫(১) শর্ত অনুযায়ী পণ্যবাহী জাহাজ এসে পৌঁছালে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল সুযোগ-সুবিধা দিবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পণ্য রফতানি ও আমদানির ক্ষেত্রে যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, সেই রকম সুবিধা তো দেওয়া হবেই। তার উপরে বন্দরে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ভারতীয় পণ্যকে। অর্থাৎ ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ এবং বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের আমদানি করা পণ্যের জাহাজ একসাথে বন্দরে পৌঁছালে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ অগ্রাধিকার পারে। এমনকি বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের পণ্যবাহী জাহাজে পচনশীল পণ্য থাকলেও ভারতীয় জাহাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে চুক্তির শর্ত মোতাবেক।
বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক এবং নির্ধারিত ট্যাক্স বাধ্যতামূলক। কিন্তু চুক্তির আর্টিকেল ৮-এর শর্ত অনুযায়ী ইন্ডিয়ান ট্রানজিটের পণ্যের ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারে শুল্ক ও ট্যাক্সের আওতামুক্ত থাকবে। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পণ্যে কোন রকমের শুল্ক অথবা ট্যাক্স দিতে হবে না।
আর্টিকেল ৬-এ বলা হয়েছে, পণ্য বন্দর হয়ে কোথায় যাবে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্য আখাউড়া হয়ে আগরতলা। চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর থেকে তামাবিল হয়ে ভারতের ডাউকি, চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর থেকে সুতারকান্দি, চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দর থেকে বিবিরবাজার হয়ে শ্রীমান্তপুর। আবার আগরগতলা থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দরে, ডাউকি থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দরে, সুতারকান্দি থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দরে শ্রীমান্তপুর থেকে চট্টগ্রাম ও খুলনা সমুদ্রবন্দরে ভারতীয় পণ্য যাতায়াত করবে। এছাড়াও ইন্ডিয়ান পণ্য নির্ধারিত গন্তব্যে পৌছাতে বাংলাদেশের যে কোন রাস্তা ব্যবহার করতে পারবে এমন শর্তও রয়েছে চুক্তিতে।
অথচ, ইন্ডিয়াপন্থি ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সিপিডিসহ দালাল কথিত বুদ্ধিজীবীরা প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন ইন্ডিয়াকে ট্রানজিট দিলে-এর আয় দিয়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মত উন্নত দেশ হয়ে যাবে। ইন্ডিয়াকে শুধু ট্রানজিট নয়, উজাড় করে সব দেওয়া হয়েছে একতরফা ভাবে। শেখ হাসিনা নিজেই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ইন্ডিয়াকে যা দিয়েছি সারাজীবন তারা মনে রাখতে হবে।
দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে ট্রানজিটের পক্ষে যারা প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন, সময় এলে তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। রবিবার (৭ আগস্ট) বিষয়ে অনুষ্ঠিত আমার দেশ-ফেইসবুক লাইভে তিনি এ বিচারের কথা বলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন