ইদুল আজহা সামনে রেখে মহাসড়কে এবং আন্তঃজেলা মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন মোটরসাইকেলচালকরা। পাশাপাশি পদ্মা সেতুতেও মোটরসাইকেল চলাচলের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন বাইকাররা। তারা বলছেন, মাথা ব্যথা হলে যেমন মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়, তেমনি দুর্ঘটনার কারণে মোটরসাইকেল চলাচলে এমন নিষেধাজ্ঞাও সমাধান নয়।
সব ধরনের পরিবহনই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে উল্লেখ করে চালকরা আরও বলছেন, অন্য সব পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কেবল মোটরসাইকেলের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা বৈষম্যের সমতুল্য। এর পেছনে পরিবহন কোম্পানিগুলোর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিতও খুঁজে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা। চলাচল বন্ধ না করে প্রয়োজনে বাইকারদের আলাদা লেন করা বা আইনের প্রয়োগ কঠোর করার দাবিও তারা জানিয়েছেন।
ছাত্র, চাকরিজীবীসহ তরুণ বাইকারদের বিভিন্ন অনলাইন সংগঠনের সদস্যরা এক মানববন্ধনে এমন বক্তব্য উঠে আসে। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন আয়োজন করা হয়।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাইকারদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে অনলাইনে যোগাযোগ করে এই মানববন্ধন আয়োজন করেন। বাংলাদেশ মোটরসাইকেল ক্লাব, ঢাকা ওয়াইআরসি, বাইকার ব্রো, বিএমসিবিডি মোটরসাইকেল ক্লাব, বাংলাদেশি ক্লাব বাইকারসসহ অন্তত ২০ থেকে ২৫টি বাইকার গ্রুপের সদস্যরা এতে অংশ নেন।
ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবের অ্যাডমিন মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন পলাশ বলেন, ঢাকায় প্রায় ৫ লাখ বাইকার আছে। এখন এই পাঁচ লাখ বাইকার কীভাবে চলাচল করবে, সেটি নিশ্চিত নয়। কারণ এরই মধ্যে গণপরিবহনে টিকিট সংকটের কথা সামনে এসেছে। আবার কয়েক গুণ বেশি দামে টিকেট বিক্রির অভিযোগও আছে। এছাড়াও আমরা যারা চাকরি করি বা ব্যবসা করি, তারা অনেকেই ইদের দুয়েকদিন আগে বাড়ি যাই। ফিরেও আসি ইদের পরপর। তাদের জন্য বাইকই ভরসা। সেক্ষেত্রে গণপরিবহনের দিকে তাকিয়ে থাকলে আসা-যাওয়া অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এখন হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞায় আমাদের বাইকারদের ইদ আনন্দ অনেকটাই ভাটা পড়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, আমাদের দাবি— প্রয়োজনে বাইকের আলাদা লেন করে দেওয়া হোক। আমাদের মধ্যে কেউ আইন ভাঙলে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। সরকারের প্রতি আবেদন— প্রত্যেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাইকের কন্ডিশন চেক করা হোক। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কোনো সমাধান নয়। বরং আমাদের কথা বিবেচনা করে সরকারের প্রতি আবেদন— এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হোক।
বিএমসিবিডি মোটরসাইকেল ক্লাব গ্রুপের অ্যাডমিন সাব্বির হোসেন বলেন, আমরা যারা বাইকার কমিউনিটিতে অনেকদিন ধরে আছি, তারা আজ এখানে সমাবেশ করেছি। আমরা বলছি, আইন মেনে বাইক চালায় না— এমন বাইকার সংখ্যায় কম। এমন ছোট একটি গ্রুপের জন্য আমরা যারা প্রয়োজনে বা শখে বাইক চালাই, তারা সবাই ভুক্তোভোগী হচ্ছি। দুর্ঘটনা সব যানবাহনেই ঘটে। শুধু বাইকের দিকে আঙুল তোলা যুক্তিযুক্ত না। তাছাড়া দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের চালকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই। তারপরও আমরা নিজেদের প্রয়োজনে বাইক চালাই। আমাদের কথা হলো— মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা তো কোনো সমাধান না। তাই বাইকাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞাও কোনো সমাধান হতে পারে না।
এর আগে, গত রোববার (৩ জুলাই) ইদুল আজহা উপলক্ষে এক সপ্তাহের জন্য মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ইদুল আজহার আগের তিন দিন, ইদের দিন এবং ইদের পরের তিন দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত এলাকার বাইরে মোটরসাইকেল রাইড-শেয়ারিং করা যাবে না। ইদুল আজহার আগে-পরে মিলিয়ে সাত দিন সারাদেশের মহাসড়কে যৌক্তিক কারণ ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। এক জেলায় নিবন্ধিত মোটরসাইকেল অন্য জেলায় চালানো যাবে না। তবে যৌক্তিক ও অনিবার্য প্রয়োজনে পুলিশের অনুমতি নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া তরুণদের দাবি, তারা বাসা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মোটরসাইকেলে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন। অনেকেরই গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে। তারা ইদের দুয়েকদিন আগে সাধারণত বাইকেই যাওয়া-আসা করেন। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের নির্বিঘ্ন চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই ২৫ লাখ বাইকারের চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা কলেজের গণিত বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনীক দাস। তিনি সারাবাংলাকে জানালেন, মুগদার বাসা থেকে ঢাকা কলেজে মোটরসাইকেলেই যাতায়াত করেন। গ্রামের বাড়ি ধামরাই যাওয়ার জন্যও ব্যক্তিগত এই বাহনই তার ভরসা। ইদের সময় বাইক চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ফলে ইদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তার। কারণ, বাস বা অন্যান্য গণপরিবহনে যাতায়াতে ইদের অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।
পাঁচ বছর ধরে বাইক চালান সানজিদা। ঢাকায় তারা বাসা থেকে অফিসে তো বটেই, অন্যান্য প্রয়োজনেও ব্যক্তিগত এই বাহনই তার ভরসা। বিশেষ করে মেয়ে হিসেবে ঢাকায় গণপরিবহনে চলাচলের নানা ঝামেলা এড়াতে মোটরসাইকেলের বিকল্প দেখেন না তিনি।
সানজিদা সারাবাংলাকে বলেন, বাসে নারীদের বিড়ম্বনার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তাছাড়া বাস তো বাসা পর্যন্তও যায়ও না। সেক্ষেত্রে বাইকে চলাচল আমার জন্য সহজ, সময়সাশ্রয়ীও। ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসার জন্যও বাইক ব্যবহার করি। যেকোনো জায়গায় জরুরিভিত্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও মোটরসাইকেল সবচেয়ে ভালো বাহন। আমার মতো এমন কয়েক লাখ মানুষের কাছে মোটরসাইকেল নিত্যসঙ্গী তো বটেই, অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে সানজিদা বলেন, সব আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু সরকার কি এখন ২৫ লাখ বাইকারকে ঢাকায় আটকে রাখবে নাকি বাড়িতে যেতে দেবে, সেই চিন্তা সরকারকেই করতে হবে। আমরা আইনের প্রয়োগ চাই। কিন্তু বাইক বন্ধ সমাধান হতে পারে না। আমরা বাইকাররাও রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদের বাইকও বৈধভাবে নিবন্ধিত যানবাহন। আমাদের কথাও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে।
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন