বেসরকারি কলেজ পরিচালনার জন্য দুটি পৃথক সরকারি সংস্থার পৃথক দুটি বিধিমালা রয়েছে। আবার এ বিধিমালা একে অন্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে কলেজ পরিচালনা করতে গিয়ে অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডি নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষকরা। কখনো কখনো ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে সমাধান পাচ্ছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের বেসরকারি কলেজগুলো পরিচালনার জন্য ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি রেগুলেশন’ মানতে হয়। আবার এসব কলেজে নিয়োগ ও পরিচালনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা’ রয়েছে। যা মানার বাধ্যবাধতা রয়েছে। এই দুটি বিধিমালা মানতে গিয়েই সমস্যা হচ্ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে পরিপত্র, সাকুর্লার ও নীতিমালা জারির মাধ্যমে বিভিন্ন শর্তারোপ করে। এসব পরিপত্র বা সাকুর্লার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দুই সংস্থার কর্মকর্তারা উদাসীন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে অভিন্ন নীতিমালার দাবি জানিয়ে আসলেও তেমন সাড়া মেলেনি। ফলে ভুগছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি কলেজসমূহে অনার্স কোর্স পরিচালনার জন্য প্রতিটি বিভাগে সাত জন শিক্ষক থাকতে হবে এবং মাস্টার্স কোর্সে অতিরিক্ত আরো পাঁচ জন শিক্ষক অর্থাৎ মোট ১২ জন শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। প্রতিটি বিভাগে এক জন অধ্যাপক, দুই জন সহযোগী অধ্যাপক, চার জন সহকারী অধ্যাপক ও পাঁচ জন প্রভাষকসহ মোট ১২ জন থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় অনার্স কলেজে প্রতি বিষয়ে শূন্য পদে মাত্র তিন জন শিক্ষক নিয়োগের বিধান আছে। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। কোনো কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুসরণ করে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিলে তা গ্রহণ করছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়া হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে তা অবৈধ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা অনুযায়ী, চাকরিতে পাঁচ বছর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক জন সহকারী অধ্যাপক উক্ত অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে পারবেন। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত হিসেবে তিন বছরের অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ/ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ/এমপিওতে তিন বছরের সহকারী অধ্যাপক পদে এবং মোট ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকার বিধান রয়েছে। ফলে নিয়োগ নিয়ে জটিলতা লেগেই আছে।
আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, কলেজে শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নিয়োগ নির্বাচনি বোর্ড গঠন করে গভর্নিং বডির মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অথচ ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পর থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নিং বডির ক্ষমতা রহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনার্স-মাস্টার্স কলেজে অতিরিক্ত শিক্ষক প্রয়োজন হলে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে তার বর্ণনা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধিমালায়।
বেসরকারি কলেজ শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতির যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অংশে বর্ণিত হয়েছে, একটি কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদে সরাসরি অথবা পদোন্নতির মাধ্যমে গভর্নিং বডি কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া যাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জনবল কাঠামো অনুযায়ী, স্নাতক (পাস) কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি (শূন্য পদ সাপেক্ষে) এবং প্রভাষক পদে এমপিওতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা ও যোগ্যতার নিরিখে সর্বোচ্চ সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পেতে পারে। একজন শিক্ষককে তার গোটা চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ সহকারী অধ্যাপক পদেই থাকতে হবে, পরবর্তী ধাপে উঠার সুযোগ নেই। শিক্ষকরা জানিয়েছে, কলেজে ডিগ্রি (পাস) কোর্স অনুমতি নিতে গিয়ে তিন জন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বেসরকারি ডিগ্রি কলেজগুলো। আর এতেই বিপত্তি ঘটে। দুই জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হলেও তৃতীয় জন দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত হতে পারছিল না। উচ্চ আদালতে গিয়ে বিষয়টির সমাধান করতে হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি (পাস) কলেজের এ জনবল কাঠামোকে সমন্বয়হীনতার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে ৯০২টি বেসরকারি ডিগ্রি কলেজ, ৪০২টি বেসরকারি অনার্স কলেজ এবং ৬০টি বেসরকারি মাস্টার্স কলেজ রয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘দুটি নীতিমালা অনেক স্হানেই সমন্বয় নেই। গভর্নিং বডি, শিক্ষক নিয়োগসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় সমস্যা রয়েছে। আমরাও মনে করি এ বিষয়টি সমাধান করা দরকার। এ কারণে একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরির জন্য কমিটি করেছি। তবে কমিটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি। ফলে বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াই বিধিমালাগুলোতে কোথায় কোথায় অসংগতি আছে তা খুঁজে সমস্যা সমাধান করা।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন