ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানার আমিন মসজিদ গলির একটি বাসায় গত ২৩ জুন ভোরে খুন হন এক তরুণ। পুলিশের তথ্য বলছে, মাদক সেবন করতে করতেই ব্যক্তিগত কিছু বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে বচসা বাধে। এক পর্যায়ে এক তরুণ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বালিশে মাথা রাখেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য তরুণ সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে হত্যা করেন।
হত্যার শিকার তরুণের নাম রাফিন রহমান শাওন (২১)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, পুলিশের তদন্তে গত দেড় বছরে শুধু রাজধানীতেই কিশোর অপরাধীদের হাতে ৩৩ কিশোর-তরুণ খুনের তথ্য উঠে এসেছে। আর পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, একই সময়ে সারা দেশে কিশোর-তরুণ খুন হয় ৪৫ জন, যেগুলোর তদন্তে কিশোর তরুণদেরই নাম এসেছে। পুলিশের দেড় বছরের মাসিক অপরাধ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত শনিবার সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে হামলার শিকার হন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। গত সোমবার তিনি মারা যান। ওই শিক্ষকের ওপর হামলা চালায় দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। এ ছাড়া নড়াইলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে জুতার মালা গলায় দিয়ে হেনস্তা করা হয়। এতেও স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি কিশোর-তরুণদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে। সব মিলিয়ে দেশে কিশোর-তরুণদের অপরাধপ্রবণতা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
শুধু হত্যা নয়, আরো নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িত হচ্ছে। পুলিশের তথ্য বলছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, পথচারীদের হঠাৎ ঘিরে ধরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া, রাস্তায় পরিকল্পিত সংঘাত তৈরির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি করছে কিশোর-তরুণরা।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-মিডিয়া) হায়দার আলী খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা সামাজিক সমস্যা। কিশোর-তরুণদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে।
সম্প্রতি কামরাঙ্গীরচরের আমিন মসজিদ গলি এলাকায় গিয়ে শাওন হত্যার বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, সেখানে দলে দলে বিভক্ত কিছু তরুণ ও কিশোর দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর মাদক সেবন, হৈ-হুল্লোড় এবং সামান্য বিষয়ে মারামারি প্রায়ই ঘটছে। এবার একজন খুন হয়ে গেল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই কিশোর-তরুণদের নিয়ে মহাবিপদে আছি! বয়স কম হলেও তারা বড় অপরাধ করছে। আইনে বাধা থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা যায় না। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুনোখুনিতেও তারা রয়েছে। প্রতিদিনই অন্তত ১০ থেকে ১২ জন কিশোরকে নানা অপরাধের জন্য আটক করে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় দিই, কিন্তু তাতেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। ’
সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় তরুণ-কিশোরদের অপরাধ কর্মকাণ্ড বেশি বলে মনে করছে ডিএমপি। ডিএমপির মাসিক অপরাধ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ডিএমপি সূত্র বলছে, অপরাধী কিশোরদের আঁধারের পথ থেকে আলোর পথে আনতে ডিএমপি কাজ করছে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি গত বছর ২৩০ জনের একটি তালিকা করে। গত ছয় মাসে আরো ৩০ জনকে যুক্ত করে। ওই তালিকা ধরে কিশোরদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অন্যদের স্বাভাবিক পথে আনতে অভিভাবক ও পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা।
এর আগে রাজধানীর হাতিরঝিলে অভিযান চালিয়ে ১৩১ কিশোর ও তরুণকে সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে তাদের পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। তাদের কয়েকজনের অভিভাবকের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘সন্তানদের লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিকে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ’
ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে প্রতি মাসে হত্যার ঘটনা ঘটে গড়ে ২০টি। এর বেশির ভাগ ঘটনার তদন্তে কিশোর-তরুণদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসছে। আবার ২০১৮ সাল থেকে গত ২৭ জুন পর্যন্ত রাজধানীতে হওয়া ৩৮৯টি ছিনতাইয়ের অনেকগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল কিশোর-তরুণরা।
ছয় দিনে চার খুন, জড়িত কিশোর-তরুণরা
গত ২২ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত পাঁচ দিনে চারটি খুনের ঘটনা ঘটে। তদন্তে প্রতিটিতেই কিশোর-তরুণদের জড়িত থাকার তথ্য উঠে এসেছে।
কামরাঙ্গীরচরে শাওন হত্যার প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে স্থানীয় পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় অভিযুক্ত তরুণের নাম রেশাদ (২০)। এ ঘটনায় নিহতের বাবা সোহেল রানা মামলা করলে রেশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত শাওন স্থানীয় একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। রেশাদ এই হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান।
থানা সূত্র বলছে, শাওন হত্যার এক দিন আগে মোবাইল ফোন চুরি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ‘বন্ধুদের’ হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন জীবন চৌধুরী (১৯)। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাফি আহমেদ ও মো. বিজয় নামে আরো দুই কিশোর-তরুণ আহত হন। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এই হত্যাকাণ্ডেও জড়িত কিশোর-তরুণরা।
আর ২৭ জুন সাভারের আশুলিয়ায় তরুণ শিক্ষার্থীর হামলায় আহত শিক্ষক উৎপল কুমারের মৃত্যু হয়।
এরপর গত মঙ্গলবার বগুড়ার শাজাহানপুরে স্কুলছাত্র নওফেল শেখের (১৪) রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায়ও কিশোর ও তরুণদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ চক্রবর্তী। পুলিশের তথ্য মতে, নওফেলের গলায় মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করে তারই এক বন্ধু (১৬)।
রাজধানীর যেসব এলাকায় বেশি তৎপর ওরা
পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব ও পশ্চিম রসুলপুরসহ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রমনার মগবাজার, মিরপুর, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জের আশপাশের কিশোর-তরুণদের মধ্যে অপরাধ বেশি ঘটছে। পুলিশের তথ্য মতে, রাজধানীর আটটি ক্রাইম জোনে ছোট-বড় ৩০ থেকে ৩৫টি দল রয়েছে তরুণ অপরাধীদের।
কামরাঙ্গীরচর থানা সূত্র ও স্থানীয় লোকজন জানায়, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় কিশোর-তরুণদের অপরাধ তুলনামূলক বেশি ঘটছে। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত এক বছরে কিশোর-তরুণদের দ্বন্দ্বে এই এলাকায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত সাতজন।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে কিশোর-তরুণদের বেশ কয়েকটি দলও আছে। এর মধ্যে ১, ২ ও ৩ নম্বর গলি নিয়ন্ত্রণ করেন নাসির হোসেন ও তাঁর সহযোগী তুহিন (২২)। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে ৭০ থেকে ৮০ জন কিশোর-তরুণ। এদের আড্ডাস্থল মূলত পূর্ব রসুলপুর ১ নম্বর গলির মাথায়। এ ছাড়া পূর্ব রসুলপুরের ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গলি সিরাজ তালুকদার ও জাবেদ নিয়ন্ত্রণ করেন বলে এলাকাবাসী জানায়। নাসির ও তুহিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
নিয়ন্ত্রণে যা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান খন্দকার আল মঈন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই কিশোর-তরুণদের অপরাধ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে র্যাব। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। গত এক বছরে সারা দেশে র্যাবের অভিযানে দেড় শতাধিক কিশোর-তরুণকে আটক করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। ’
এর আগে একাধিক সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বারবার এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, ‘যে তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেবে, সেই কিশোর-তরুণরা যেন পথ না হারায়, এ জন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আটকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কিশোর সংশোধনাগারে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ’
অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘সমাজে এখন মাদক কারবার আর কিশোর-তরুণদের অপরাধ বেড়েই চলছে। একসময়, বিশেষ করে ৯০-এর দশকের দিকে পারিবারিক অনুশাসনের মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। এর পর থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সামাজিক যে অনুশাসনগুলো ছিল সেগুলো সমাজে এখন আর আগের মতো কাজ করছে না। পরিবার, প্রতিবেশী ও এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চার বন্ধনগুলো নষ্ট হয়ে ছন্দঃপতন ঘটেছে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বলা চলে একদমই নেই। এসব কারণে কিশোর-তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বিষয়ে আরো তৎপর হতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন