ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো কৃত্রিম অর্থনীতির বেলুন ফুটো হতে চলেছে। বাজারে চড়া মূল্য, সঞ্চয়হীন অভাবী মানুষ, চাকুরির সংকোচিত বাজার, দুর্নীতি ও মহা লুটপাটে ধংসের মধ্যে গোটা ব্যাংকিং খাত, শ্রমবাজারে ধস নেমে আয় কমে গেছে রেমিট্যান্সের। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও জ্বালানি ব্যয় বেড়ে রপ্তানি খাতেও অস্থিরতা চলছে। এরই মধ্যে টান পড়েছে রিজার্ভে। সব মিলে এক বেসামাল অবস্থায় পড়েছে দেশের অর্থনীতি।
কয়েক মাস আগেও সরকারের যেসব মন্ত্রী-আমলারা দেশকে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের কাতারে ফেলে যে ধোঁকাবাজি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তারাও এখন চুপ। আমদানি ব্যয় মেটাতে না পেরে ইতিমধ্যে “বিলাসী পণ্য” আখ্যা দিয়ে অনেক পণ্য আমদানিই বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এখন অবৈধ সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে আকুতি জানাচ্ছেন মানুষ সঞ্চয় করার জন্য। বলছেন বিদেশ যাওয়া কমাতে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসবের কোন মূল্য নেই। দেশের অর্থনীতি যে গভীর খাঁদের কিনারে আছে, সেখান থেকে টেনে উঠানো এতো সহজ নয়।
রিজার্ভ, আমদানি ব্যয়, রপ্তানি বাজার সংকীর্ণ হয়ে পড়া ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে সরকার এবার ধর্না দিচ্ছে বিদেশী বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে রিজার্ভের যে অবস্থা তা দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। সেই সাথে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ফলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
গত সোমবার দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে, যা দিয়ে হয়ত প্রায় ৫ মাসের আমদানির খরচ মেটানো যাবে। কিন্তু চলমান এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’র পরামর্শ হচ্ছে, রিজার্ভে যেন ৮-৯ মাসের আমদানির খরচের সমপরিমাণ টাকা রাখা হয়।
আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে ২ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে আসবে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভুটান, ইরান, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেন করে থাকে। অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতির বেসামাল গতি দেখে সরকার ইতিমধ্যে কঠিন কঠিন শর্তে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ নিতে তদবির শুরু করেছে। এসব শর্তের মধ্যে আছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আরও কমানো, করবিহীন অর্থকে বৈধ করার শর্তহীন সুযোগ বাতিল, বৈদেশিক মুদ্রা নীতি শিথিল ও বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাংলাদেশে গত এপ্রিলে ঈদ উল ফিতরের সময় প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়লেও এরপরই মে মাসে ১৩ শতাংশ কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চলতি অর্থবছরের মে মাস জুড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার যা আগের মাসের তুলনায় প্রায় তের কোটি ডলার কম। এপ্রিল মাসে দেশে ২০১ কোটি দশ লাখ ডলার এসেছিলো। এমনকি গত অর্থবছরে একই সময়ে দেশে এর চেয়ে বেশি অর্থ এসেছিলো। তখন এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিলো ২১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সরকারের রেমিট্যান্স অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ছাব্বিশ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম এগার মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১৯দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে সরকার পাঁচ লাখ টাকার উপর পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাওয়ার শর্ত শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় পাঠাতে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট দিতে হতো বলে অনেকেই বেশি পরিমাণ অর্থ পাঠাতে পারতেন না। কিন্তু শর্ত শিথিলের কারণে এখন থেকে কোন নথিপত্র ছাড়াই অর্থ পাঠালে প্রণোদনা পাবেন তারা। এর পরও চলতি অর্থ বছরে এপ্রিল মাস ছাড়া কার্যত বাকী সময় জুড়েই রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিলো নেতিবাচক। জুনেও একই অবস্থা। কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে ডলারের বাজার চরম অস্থিতিশীল। পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো ঠিকমতো আমদানি ঋণপত্র বা এলসি ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। খোলা বাজারে এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়। এ কারণে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসছে দেশে।
ওদিকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রবাসী আয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘অভিবাসন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে চলতি বছর ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ মাত্র দুই শতাংশ বাড়তে পারে। এই প্রতিবেদনে ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হারকে অনিশ্চিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় উৎস হলো রেমিট্যান্স।
এদিকে স্থানীয় টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে দেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের সংকট এখন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। ব্যাংকগুলো ৯৭ টাকায়ও এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার পাচ্ছে না। ফলে ৯৯ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে ঈদের আগে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ে যে সুবাতাস আসে, এবার তা–ও নেই। কারণ, হুন্ডিতে পাঠালে প্রতি ডলারের বিনিময়ে এখন ১০৫-১১০ টাকা পর্যন্ত দাম মিলছে। এর ওপর বাড়িতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার ডলারের দাম আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়েছে। ফলে প্রতি ডলারের দাম ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ডলারের সংকট কাটাতে বিলাসপণ্য আমদানিতে আরও কড়াকড়ি আরোপ হতে পারে। বিশেষ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ ও শতভাগ মার্জিন আরোপ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ক্রমাগত ডলার–সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দফায় দফায় এটির দাম বাড়াচ্ছে। ফলে গত দুই মাসে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায় উঠেছে। এটাকে আন্তব্যাংক দাম বলে উল্লেখ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলোতে এই দামে কোনো ডলার লেনদেন হচ্ছে না।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রবাসী আয় সংগ্রহে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি অগ্রণী ব্যাংক। এরপরও ব্যাংকটির প্রতি মাসে ডলারের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি ডলার। এ নিয়ে ব্যাংকটি সব শাখা ব্যবস্থাপকদের চিঠি দিয়েছে। এতে বলেছে, ব্যাংকের ডলার খরচ ১৭০ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি মুদ্রা আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো না গেলে বৈদেশিক বাণিজ্যে বিপর্যয় আসতে পারে। সামনে বিদেশি মুদ্রার সংকট আরও বাড়বে। এ জন্য শাখা ব্যবস্থাপকদের নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও বিদেশে ডলার পাঠানোর অঙ্গীকার না করার পরামর্শ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দুর্বল অর্থনীতির কবলে পড়ে রেমিট্যান্স আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে দেশের রিজার্ভ ব্যবস্থা। এতে বড় বিপদের মুখে পড়েছে দেশ। এখন যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো হয়ত সম্ভব। আবার আমদানি খরচ বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। এভাবে বাড়তে থাকলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে রিজার্ভের হিসাব সঠিক নিয়মে করার। সেটি করতে গেলে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানিকারকদের ঋণ তহবিল, সরকারি প্রকল্প ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণ এবং সোনালী ব্যাংকে রাখা আমানত রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ কমবে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি। এখন রিজার্ভ রয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন