নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বক্তব্যকে ‘দায়িত্বহীন’ বলে মন্তব্য করেছে তারা। এ ঘটনায় ইন্ধনদাতাদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয় তাদের বিবৃতিতে।
বুধবার এক বিবৃতিতে উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে জানান, ‘গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, নড়াইলের ওই কলেজে শিক্ষক লাঞ্ছনার পেছনে শুধু ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগই কারণ নয়। কলেজটিতে কিছুদিন আগে অবৈধভাবে কয়েকজনকে নিয়োগের বিরোধিতা করেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের রোষানলে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে কলেজের এক ছাত্রের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ কলেজে হামলা করলে তিনি কলেজের নিরাপত্তা রক্ষায় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিকভাবেই সহায়তা চেয়ে পুলিশকে ফোন করেন। এ ঘটনাকে অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন এবং স্বপন কুমার বিশ্বাসও ধর্ম অবমাননা করেছেন বলে গুজব রটিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা হয়’।
তারা আরো বলেন, ‘পরবর্তীতে পুলিশের উপস্থিতিতেই অধ্যক্ষসহ তিনজনের গলায় জুতার মালা পরিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে স্পষ্ট বোঝা যায়’।
বিবৃতিতে বলা হয়, উদীচী মনে করে, প্রায় আট ঘণ্টা ধরে কলেজ ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালানো হলেও তা ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন। শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো তাকে অসম্মানিত করার পূর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। কেন না, তাদের উপস্থিতিতেই বিনা বাধায় ওই শিক্ষকের গলায় জুতোর মালা পরানো হয়’।
উদীচীর নেতারা বলেন, ‘এত কিছুর পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘পুলিশ কিছু করার আগেই উত্তেজিত জনতা লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে’, তখন সেটি নিছক দায়িত্বহীন মন্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে ব্যর্থতার দায়ে নড়াইলের পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা সেখানে ঘটনার ১১ দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, দায়িত্বে কারো গাফিলতি ছিল কি না তিনি তা খতিয়ে দেখবেন’।
‘এ মন্তব্য এবং অহেতুক কালক্ষেপণের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আড়ালের চেষ্টা চলছে কি না’ সে প্রশ্নও তোলেন উদীচীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
তারা বলেন, ‘অতীতে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত, নওগাঁর আমোদিনী পাল বা মুন্সিগঞ্জের হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা ও হয়রানির ঘটনার কোনো সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার ফলেই বারবার শিক্ষকদের লাঞ্ছনার এমন ঘটনা ঘটছে।
নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনার সুষ্ঠু বিচার না হলে প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে উদীচী দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলবে বলেও বিবৃতিতে ঘোষণা দেন উদীচীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
বুধবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা পর্যালোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘অকস্মাৎ অনেক ঘটনা ঘটে যায়, যেগুলো হঠাৎ করেই ঘটে যায়। এই ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত, এ ধরনের একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা।’
‘ঘটনাটি খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছে। মনে হয়েছে, উত্তেজিত জনতা এত বেশি একত্র হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ডিসি-এসপির কিছু করার আগেই ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা আসলে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। আসল ঘটনাটা কী হয়েছিল সেটা জেনে আপনাদেরকে জানাব।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর পর আমরা হঠাৎ করেই দেখছি; আমরা ফেসবুক নামক যন্ত্রে খুব বেশি নিজের কথা, অন্যের কথা প্রচার করে থাকি কিংবা লাইক দিয়ে থাকি। সেখানে আমরা বলব... না জেনে না শুনে- নিজের কথা না বুঝে ফেইসবুকে কোনো উক্তি বা কমেন্টস না করার জন্য আমি পরামর্শ দেব।’
নড়াইলের ঘটনায় পুলিশের কোনো অবহেলা ছিল কি না জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘কেউ কোনো দায়িত্ব অবহেলা করলে- পুলিশ করুক কিংবা আমাদের জেলা প্রশাসক করুক কিংবা যেই করুক, কিংবা কোনো জনপ্রতিনিধি করে থাকুক, সেখানে সবাই ছিল, আমি শুনতে পেয়েছি। সেখানে কার কতখানি গাফিলতি রয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা খতিয়ে দেখছি।’
এদিকে শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ১৪টি জাতীয় সাংস্কৃতিক ফেডারেশন।
বুধবার জাতীয় সাংস্কৃতিক ফেডারেশনের দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে সাভারে শিক্ষক হত্যা, নড়াইলে অধ্যক্ষ নির্যাতনসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষকদের অপদস্থ করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এসব ঘটনার নেপথ্যে মদদদাতাদেরও শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
বিবৃতিদাতা ১৪ সাংস্কৃতিক ফেডারেশনের মধ্যে রয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, কবিতা পরিষদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, পথনাটক পরিষদ, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থা, চারুশিল্পী সংসদ, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র, যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ, গ্রাম থিয়েটার, শিশু সংগঠন ঐক্যজোট, অভিনয় শিল্পী সংঘ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন