মানবাধিকার ইস্যুতে সুপ্রীম কোর্ট উপহাস করলেও পদ্মা সেতু নিয়ে যেন উদ্বেগের অন্ত নেই। এতটাই উদ্বিগ্ন যে, পদ্মা সেতুর কথিত বিরোধীদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। অথচ মানবাধিকার ইস্যু গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর দেখা গেছে এই সুপ্রিমকোর্টকে।
শেখ হাসিনার অনুগত আওয়ামী বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার ও কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কমিশন গঠন করে কথিত বিরোধীতাকারী খোঁজার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মঙ্গলবার (২৮ জুন)। ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন গঠনের জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে সরকারকে। আর এই আদেশ দেয়া হয়েছে স্বপ্রণোদিত হয়ে জারি করা একটি রুলের সূত্র ধরে। কতটা উদ্বিগ্ন হলে স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
পদ্মা সেতুর কথিত বিরোধীতাকারী খুঁজতে ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছিল শেখ হাসিনার অনুগত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ। এই রুলের পরিপ্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার (২৮ জুন) কমিশন গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার একটি কমিশন গঠন করবে। তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার কিছু লোককে দায়ী বানিয়ে রিপোর্ট দিবে হাইকোর্টে। এরপর কি হবে সেটা সকলেই বুঝে নিতে পারেন। শেখ হাসিনা তখন বলবেন, আমি কিছু করি নাই। আদালতের নির্দেশ মানতে হবে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী স্বার্থে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে এরকম অনেক নির্দেশনা জারি করলেও মানুষের অধিকার রক্ষায় গত ১৪ বছরে কোন রকমের রুল জারি করতে দেখা যায়নি। বরং ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বেঞ্চ রুল জারি করেছিল। এই রুল জারির পর সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের পরিণতি ভাল হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রধান বিচারপতি পরের দিনই বেঞ্চ ভেঙ্গে দিয়েছেন এমন নজিরও রয়েছে। এতে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগ বিচারবহির্ভূত হত্যা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছেন শেখ হাসিনাকে।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে মাদারীপুরে খালাসি ভ্রাতৃদ্বয়কে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছিল র্যাব। এই বিচারবহির্ভূত হত্যার পর ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিল। এএফএম আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ থেকে জারি করা নির্দেশনায় দুই ভাইকে ক্রসফায়ারে হত্যার বিষয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল র্যাবকে। এই রুল জারির পরের দিনই তৎকালীন আওয়ামী প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ ভেঙ্গে দিয়ে বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমানের বিচারিক ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। এরপর তাঁর অবসরে যাওয়ার আগে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন বিষয়ে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ২৮ জুন হাইকোর্ট বিভাগের অপর একটি বেঞ্চে দু’টি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদন করেছিল। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না মর্মে কারণ দর্শাতে সরকারের প্রতি রুল জারি করা হয়েছিল। এই রুল জারির পর এই বেঞ্চের বিচারকদের পরিণতিও ভাল হয়নি। এই দুই বিচারক ইতোমধ্যে অবসরে যাওয়ার আগে আর রুলের শুনানীর সুযোগ পাননি।
২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বেঞ্চ মানবাধিকার নিয়ে এরকম একাধিক রুল জারি করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার অনুগত আপিল বিভাগ ও প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সে গুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিচারকদের বিচারিক ক্ষমতা খর্ব করে গুরুত্বহীন করেছেন। এনিয়ে ২০১০ সাল এপ্রিল মাসে ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এই প্রতিবেদনে তথ্যপ্রমাণসহ দেখানো হয়েছিল কিভাবে আপিল বিভাগ ও প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছেন।
এ প্রতিবেদনের কারণে, আমার দেশ সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে শুনানীর সময় তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে, প্রকাশ্যেই বিচারপতিরা বলেছিলেন- “ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স”। বরং আদালত অবমাননার অভিযোগে সম্পাদক এবং প্রতিবেদককে আইন বহির্ভূত কারাদণ্ড এবং জরিমানা করা হয়েছিল।
২০০৯ সালের পর থেকে মানবাধিকার ইস্যুতে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা তো দূরের কথা, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় সে বিষয়ে তৎপর দেখা গেছে বিচার বিভাগকে। সরকার ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে গুম করছে। তাদের খুঁজে বের করার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন জানালেও কোন রকমের নির্দেশনা পায় নি। অনেক গুম হওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে গেলে তা গ্রহণই করা হয়নি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের পরিবার হাইকোর্ট বিভাগে নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেছিল। তাদের আবেদন হাইকোর্টের কোন বেঞ্চ গ্রহণই করেনি। বরং পদ্মা সেতুর কথিত বিরোধীতাকারী খুঁজতে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রুল জারি করার পর এখন কমিশন গঠনের তাগিদ দিয়েছে আওয়ামী হাইকোর্ট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন