বরিশাল শহরের মেহেদি হাসানকে ২০২১ সালে ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করে মহানগর গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পুলিশ। এ মামলায় গত ১৫ জুন বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মেহেদিকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেন। পরে সাজা পাওয়া ওই যুবককে অসুস্থ মায়ের সেবা ও ১০০টি গাছ রোপণের শর্তে মুক্তি দেন আদালত। এদিকে মানহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড পান চট্টগ্রামের সংগীতশিল্পী ফাহমিদা রহমান। গত ১৪ জুন তাকে কারাদণ্ডের বদলে ছয় মাস পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর নির্দেশ দেন আদালত। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ রায় দেন।
সূত্র জানায়, কারাগারের বাইরে রেখে সাজাপ্রাপ্তদের সংশোধনের সুযোগ দিতে দীর্ঘদিনের পুরোনো আইনটি সচল করা হয়। প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে এ সুযোগ পাচ্ছেন তারা। ১৯৬০ সালে প্রণীত আইনটি এতদিন সচল না অচল, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। দেশের কারাগারগুলোয় প্রায় প্রতিদিনই ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত আসামি রাখা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১৯ সালে আইনটি কার্যকর করতে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এরপর হাইকোর্টসহ দেশের বিভিন্ন আদালত এ আদেশ কার্যকর করতে দেখা যায়। সারা দেশে এ পর্যন্ত শতাধিক আদালতের রায়ে তিন শতাধিক ব্যক্তি সংশোধনের সুযোগ পেয়েছেন।
আদালতের এমন ব্যতিক্রমী রায় ইতিবাচক উল্লেখ করেছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, ছোটখাটো অপরাধ হলে তাকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেও এমন আইন চালু রয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আদালতের এমন পদক্ষেপের একটা ইতিবাচক দিক আছে। আইন অনুযায়ী আদালত যে রায় দিয়েছেন এতে সত্যিকার অর্থে আসামিরা সংশোধনের একটা সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবারের একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।
আইনে যা আছে : ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’ আইনের ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী, ‘পূর্বে দণ্ডিত হয়নি এমন কারও অনধিক দুই বছরের সাজা হলে আদালত অপরাধীর বয়স, স্বভাব-চরিত্র, শারীরিক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন দেখে তাকে অব্যাহতি দিতে পারেন। অথবা উপযুক্ত মনে করলে আদেশের সময় থেকে অনধিক এক বছর কোনো অপরাধ করবে না এমন শর্তে জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা দিয়ে বিমুক্ত হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।’
ছয় শর্তে বাড়িতে মা-বাবার জিম্মায় থেকে সাজা ভোগ করবে সুনামগঞ্জের ৭০ শিশু : বিভিন্ন অপরাধে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ৫০টি মামলায় জড়ানো হয়েছিল সুনামগঞ্জের ৭০ শিশুকে। এসব মামলায় এক বছর করে সাজা হয় তাদের। তবে কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি। সংশোধনের ছয় শর্তে বাড়িতে মা-বাবার জিম্মায় থেকেই এ সাজা ভোগ করবে তারা। শিশুদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর। ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’ অনুযায়ী সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু আদালতের বিচারক ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর এসব মামলার রায় দেন। জানা যায়, মামলার কারণে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো এসব শিশুর। এতে শিক্ষাসহ স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছিল তাদের।
মায়ের সেবা ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালানোর শর্তে সাজা স্থগিত : শরীয়তপুরের মতি মাতব্বরের কাছ থেকে ৪১১ এবং অপর এক আসামির কাছ থেকে ৭০০ ইয়াবা উদ্ধার হয়। ওই মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে হাকিম আদালত তাদের পাঁচ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। পরে আসামি মতি মাতব্বর ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করলে বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ সাজা স্থগিত করে রায় দেন। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী দেড় বছর তাকে প্রবেশনে থাকতে হবে। শর্ত যথাযথভাবে পালন করলে তার বাকি সাজা মওকুফ হয়ে যাবে।
মাদকবিরোধী প্রচারসহ বিভিন্ন শর্তে বাড়িতে থাকবেন : সাতক্ষীরায় মারামারির ঘটনায় একই পরিবারের স্বামী-স্ত্রীসহ চারজনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসমিন নাহার। ২০১৯ সালে দেওয়া রায়ে আসামিদের কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশন আইনে আদালত তাদের বাড়িতে থেকে সাজা ভোগের এবং সংশোধনের সুযোগ দেন কয়েকটি শর্তে। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়িতে থাকা আসামিরা হলেন-আশাশুনি উপজেলার মহিষাডাঙা গ্রামের গৌতম গাইন, মমতা গাইন, লতিকা মন্ডল ও ঊর্মিলা গাইন। শর্তের মধ্যে রয়েছে মাদকবিরোধী প্রচার, আসামিরা বাদীকে ১০টি বনজ ও ১০টি ফলদসহ ২০টি গাছ দেবেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রচারণা, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা এবং কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া না করা।
নিজ বাড়িতেই ১১ শর্তে ৬ মাস সাজা খাটবেন আসামি : খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলায় মারধরের অভিযোগে আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় ২০১৯ সালে এক আসামির ব্যতিক্রমী সাজা দেন খাগড়াছড়ির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সামিউল আলম। ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে আদালত বলেন, কারাগারের পরিবর্তে নিজ বাড়িতেই এই সাজা ভোগ করবেন তিনি।
মহল্লার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়েছিল রাজশাহীর একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রত্যয় কুমার সাহা। ৪৫টি ইয়াবাসহ ধরা পড়ে প্রত্যয়। এ মামলার বিচার শেষে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। তবে আদালত তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে ‘প্রবেশন’ ব্যবস্থার আওতায় পরিবারের হাতে তুলে দেন। এদিকে মাগুরায় নিু আদালত মাদক মামলার একটি রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কারাগারে না পাঠিয়ে ১০টি গাছ লাগানোর আদেশ দেন। কক্সবাজারে প্রতারণার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে নামাজ পড়া এবং এতিমদের খাওয়ানোর আদেশ দেওয়া হয়।
আদালতের এমন রায়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। তিনি বলেন, আদালতের এমন রায়ে এক দিকে যেমন দেশের কারাগারগুলোতে চাপ কমবে অন্য দিকে ছোটখাটো অপরাধ হলে আসামিকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, কিছু কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে পারিবারিক মামলায় স্বামী-স্ত্রীকে আদালত মিলিয়ে (মীমাংসা) দিচ্ছেন। এটা ঠিক আছে, এতে সমস্যা নেই। তবে অপরাধের মাত্রা দেখে সাজা দেওয়া উচিত। আইন মোতাবেক রায় যা নির্ধারণ করা আছে সেটাই দিতে হবে। এর বাইরে রায় দিলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন