পাকা সড়কটির বেশির ভাগই ডুবে গেছে। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান, আবার কোথাও বুকসমান পানি। এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় সড়ক দেখা যাচ্ছে। এমন একটি স্থানে কিছু কৌতূহলী ও বানভাসি মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলাই মিয়া (৪০)। পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাতাকাটা সাদা গেঞ্জি। থইথই পানির দিগন্ত পেরিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। গোধূলির আলোয় সেখানে একটি ঘরের রুপালি টিনের চাল পানির ওপর চিকচিক করছে। সেই ঘরটি বলাই মিয়ার।
বলাই মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচা ঘর। একটু আগে দেখিয়া আইলাম (আসছি) বেড়া ভাঙি পড়ের। পাকা পিলার (খুঁটি) থাকায় কিছু কিছু খাঁড়া আছে অখনো (এখনো)। কিন্তু অত বড় হাওর। কোন সময় আফাল (ঢেউ) দিব। ঘর টিকব কিনা কে জানে। পানির কাছে ধনী-গরিব কিচ্ছু নাই, সব সমান। পানিয়ে সবরে (সবাইকে) দৌড়ার।’
গতকাল বুধবার বিকেলে বলাই মিয়ার সঙ্গে দেখা হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল-ভুকশিমইল সড়কের পূর্ব মাধবপুরে। তাঁর বাড়ি হাকালুকি হাওরপাড়ের গ্রাম মুক্তাদিরপুরে। এই গ্রামটি পড়েছে কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নে। গত কয়েক দিনে হাকালুকি হাওরে দ্রুত পানি বাড়ায় পুরো মুক্তাদিরপুর গ্রাম এখন পানির নিচে। দূর থেকে কিছু সবুজ গাছগাছালি আর টিনের চাল সাদা দেখা যায়। গ্রামের অনেকের ঘরেই এখন হাঁটুপানি, বুকপানি। যাঁদের ঘরে বুকসমান পানি, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগেই ঘর ছেড়েছেন। অন্যরা পানিবন্দী অবস্থাতেই ঘরে থাকার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ প্রতিবেশীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।
বলাই মিয়া জানান, তাঁর ঘরে এখন কোমরসমান পানি। সেখানে থাকতে না পেরে গত শুক্রবার পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে তিনি বাড়ি ছাড়েন। উঠেছেন বরমচাল ইউনিয়নের পূর্ব মাধবপুরে এক মামার বাড়িতে। এখানেও হাওরের পানি ঘরের ভিটেতে ছুঁই ছুঁই করছে। তাঁর একটি ভাঙাচোরা নৌকা আছে, সেটি নিয়ে প্রতিদিন নিজের বাড়ি দেখে আসেন তিনি। এরই মধ্যে তাঁর ঘরের বেড়ার অনেকটুকু ভেসে গেছে। পাকা খুঁটি আঁকড়ে আছে কিছু। হাকালুকি হাওরের ঢেউ নিয়ে এখন তাঁর সব ভয়। বারবার ঢেউ ঘরে এসে আঘাত করলে ঘরটিও পড়ে যেতে পারে।
পানি বাড়ের। রুজিরোজগার নাই। কেমনে চলতাম। খালি আমিই না, সারা (এলাকার) মানুষই টেনশনে, কেমনে বাঁচত। এর মাঝে এত বড় হাওর, তুফানর ডর। তুফান দিলে ঢেউয়ে ঘরবাড়ি থাকত নায়
বলাই মিয়া, হাকালুকি হাওরপাড়ের বাসিন্দা
পূর্ব মাধবপুরের ওই সড়কে দেখা হয় মুক্তাদিরপুর গ্রামের মো. মানিক মিয়া, ফয়সল আহমদ ও ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা জানান, তাঁদের ঘরেও পানি। কেউ অন্যের ঘরে উঠেছেন, কেউ কোনোরকমে নিজের ঘরে থাকার চেষ্টা করছেন। চারদিকের খবর জানতে নৌকা নিয়ে বিকেলে সড়কে এসেছেন। যাঁদের নৌকা আছে, তারা এদিক সেদিক একটু যেতে পারেন। যাঁদের নৌকা নেই, তাঁরা ঘরেই পানিবন্দী হয়ে আছেন। বরমচাল-ভুকশিমইল সড়কে পানি ওঠায় পাঁচ-ছয় দিন ধরে এই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ আছে।
বলাই মিয়া বলেন, ‘২০০৪ সালে বড় পানি অইছিল (বন্যা হয়েছিল)। কিন্তু উঠান পর্যন্ত পানি উঠছিল। ঘর ছাড়া লাগছিল না। জীবনের পয়লা (প্রথম) পানির লাগি এবার ঘর ছাড়লাম। এ রকম পানি আমার বোঝও (বোঝার বয়সে) অইছে না (হয়নি)। মুরব্বিরা কইছইন (বলেছেন) আরও একবার ৩৬ বাংলায় এ রকম পানি অইছিল (হয়েছিল)।’
তিনি জানান, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নৌকা দিয়ে তাঁর বাড়িসহ পানিতে তলিয়ে যাওয়া সবার বাড়িঘর ঘুরে দেখেছেন। তবে এ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি তিনি। কারও কাছে কিছু চাইতেও অভ্যস্ত নন। নিজের বলতে দুই শতকের একটুকরো ভিটেই আছে। বর্গাচাষ করে সংসার চালান। কিছু ধান ছিল, সেগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পেরেছেন। যেখানে উঠেছেন, সেখানে নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে চলছেন। ঘরে পানি ওঠায়, ঘরবাড়ি ছাড়ায় সময়টা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। তারপরও এই পরিস্থিতিতে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছেন না, অন্যদের নিয়েও ভাবনা রয়েছে তাঁর।
বলাই মিয়া বলেন, ‘পানি বাড়ের। রুজিরোজগার নাই। কেমনে চলতাম। খালি আমিই না, সারা (এলাকার) মানুষই টেনশনে, কেমনে বাঁচত। এর মাঝে এত বড় হাওর, তুফানর ডর। তুফান দিলে ঢেউয়ে ঘরবাড়ি থাকত নায়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন