বিদেশে পলাতক ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে অগ্রণী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক। ইতোমধ্যে ঢাকাস্থ কানাডার হাইকমিশনে চিঠি দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। তবে এই চিঠির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করা তাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য তারা সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, দূতাবাসে পাঠানো চিঠিতে কানাডায় অবস্থান করা ব্যাংকটির কয়েকজন ঋণখেলাপি গ্রাহকের নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। কীভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে কিংবা কানাডা সরকারের সহায়তায় ঋণের টাকা আদায় করা যায় সে বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘খেলাপিদের মধ্যে যারা দেশে আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আর যারা বিদেশে রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কানাডা হাইকমিশনে চিঠি লিখেছি, যেন তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য দিতে চাননি তিনি।
সূত্র জানায়, অগ্রণী ব্যাংকের বেশকিছু বড় খেলাপি কানাডায় সপরিবারে অবস্থান করছেন। এজন্য প্রাথমিকভাবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে আরও যেসব দেশে ঋণখেলাপিরা অবস্থান করছেন সেসব দেশের দূতাবাসেও চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের পথ অনুসরণ করে আরও কয়েকটি ব্যাংক এমন উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু চিঠি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। ক্রোক করতে হবে তাদের সম্পদ। জেলে ঢোকাতে হবে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে। তা না হলে ঋণের টাকা আদায় হবে না।’
এছাড়া তিনি খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘২০১৯ সালে আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চে নিঃসন্দেহে সে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে, যা ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাল ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ আদালতের নির্দেশে বিপুল অঙ্কের ঋণ আটকে আছে। যেগুলো খেলাপি করা যাচ্ছে না। ২ শতাংশ সুবিধার আওতায় অনেক মন্দ ঋণ খেলাপির ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এছাড়া অনৈতিকভাবে রিশিডিউলের আওতায় আছে আরও বড় অঙ্কের ঋণ। ঋণ অবলোপনসহ সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের তথ্য এখনো কার্পেটের নিচেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে।’
এদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে জানান, ‘দায়িত্ব নেওয়ার সময় তার ব্যাংকে ২৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ ছিল। এখন সেটা ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনার কারণে ২০২১ সালে কিছুটা বেড়েছে। করোনার সময় ব্যবসায়ীরা ভালো অবস্থানে ছিল না। এখন সেটা আবার কমে যাচ্ছে। তবে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের অবস্থা অনেক বেশি ভালো। এখন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অগ্রণী ব্যাংকের সেবা নিচ্ছে। যেটা আগে ছিল না। বড় গ্রুপগুলো এখন অগ্রণীর গ্রাহক।’
অপর একটি ব্যাংকের এমডি যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামে একসময় তার ব্যাংকের দ্বিতীয় ইনকাম সোর্স ছিল। কিন্তু একটা সময় পুরোনো ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তিনি এখন তাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।’ তিনি জানান, অনেকে খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন। তাদেরও সুযোগ দিচ্ছি। আর যারা আসবেন না, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
বড় ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, বড় ঋণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। যারা বড় ঋণ নিয়েছেন, তারা দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ী। তাই তাদের নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। শঙ্কা এবং উৎকণ্ঠা রয়েছে আগের ঋণগুলো নিয়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রামভিত্তিক যেসব বড় ঋণ রয়েছে, তাদের নিয়ে উৎকণ্ঠা একটু বেশি। তবে সেসব ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।
প্রসঙ্গত, গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি-মার্চ-এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তিন মাস আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ঋণখেলাপি থেকে টাকা আদায়ে এখন কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে অর্থঋণ আদালত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত খুবই সক্রিয়। তাই বিভিন্ন ব্যাংকও টাকা আদায়ে আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। গত এক বছরে ২৫ ঋণখেলাপিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। গত কয়েক বছরে বেসরকারি এবি ব্যাংকের অনেক ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের একজন কানাডাফেরত ঋণখেলাপিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বাংলাদেশ ব্যাংকও আদালতে আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় দীর্ঘদিন আদালতে আটকে থাকা টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন