সীমাহীন দূর্নীতি-লুটপাট ও চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আরেক দফা দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসছে বিদ্যুৎ খাতে। অবৈধ হাসিনা সরকার জনগণের দুর্দশাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আগামী সপ্তাহেই বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এই মূল্যবৃদ্ধিকে মূলত আওয়ামী লুটেরাদের লুটপাটের খেসাড়তের ফল হিসেবেই দেখছেন সাধারণ মানুষ।
বিদ্যুতের মূল্য পাইকারি পর্যায়ে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধির করা হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে এই বৃদ্ধির হার ৫৮ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহনভাড়া বৃদ্ধি, বাসাভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাবিধ চাপের মধ্যেই নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে আরও কঠিন করে ফেলবে। পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লেও তা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাঁধে এসে পড়ে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানে বাজারে সবকিছুরই দাম বাড়বে আরও এক দফা।
গত ১২ বছরে কয়েক দফায় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৯৬ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। গ্যাস, বিদ্যুত ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সাথে সরাসরি বাজার দরের সম্পর্ক রয়েছে। এসবের দাম বাড়ার সাথে সাথেই মানুষের জীবন-যাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়।
অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হলেও, এ খাতের লুটপাটের কারণে লোকসান কমছে না। গত অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর শেষে লোকসানের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ খাতে মহা লুটপাটের সবচেয়ে বড় উদাহরণ গত ১০ বছরে সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখেই ৭০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এই টাকা ভাগবাটোয়ার মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে সরকারি লুটেরাদের হাত ধরে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে কিছু ভুল পরিকল্পনার কারণে এ খাতটি প্রায় ডুবতে বসেছে। দেশে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৫২টি। এর অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস’ (আইইইএফএ) ২০২০ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া দেয়া হয়।
ক্যাপাসিটি পেমেন্টের কারণে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যেটুকু বিদ্যুৎ কেনা হয় তার দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৬০০ টাকা পর্যন্ত পড়ে যাচ্ছে, যা একটি বিস্ময়কর ঘটনা।
বাংলাদেশ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা প্রকৌশলী শামসুল আলম দাবি করেন, এইসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আসলে সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি। এর উদ্দেশ্যই ছিল একটি গোষ্ঠীকে লাভবান করা। সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী তারা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ভাড়া পাচ্ছে। এখন তার চাপ আসছে সাধারণ মানুষের উপরে।
তিনি বলেন, ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ আমদানি করি বাণিজ্যিক রেটে। তাও প্রতি কিলোওয়াট ৬ টাকা ২৫ পয়সা দামে, যা বাংলাদেশের তুলনায় কম। এখন সারাদেশে বিদ্যুৎ দেয়া হলো। কিন্তু মানুষ যদি উচ্চমূল্যের কারণে বিদ্যুৎ না কেনে তাহলে কী হবে? আসলে পরিকল্পনাটা গণমুখী ছিল না। যারা পরিকল্পনা করেছেন তাদের মাথায় ছিল লুটপাট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুত খাতে লুটপাটের কারণে এই খাতটি পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার দশায় পড়েছে। আর এ কারণে সরকার দাম বাড়িয়ে খাতটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। যদি এখন বিদ্যুত খাতে সরকারের ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ায়, তার প্রভাব বিদ্যুতের সঙ্গে যুক্ত সব খাতে পড়বে। শিল্প উৎপাদনের খরচ বাড়বে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরো বাড়বে। কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
দেশে বিদ্যুৎ নিয়ে চরম অসস্তোষ বিরাজ করছে গ্রাহকদের মধ্যে। আবাসিক গ্রাহক, ব্যবসায়ী, অফিস-বাণিজ্যিক গ্রাহকসহ সব পর্যায়ের গ্রাহকদের মধ্যেই এই অসন্তোষ। নিয়মিত বিদ্যুৎ পরিশোধ করেও প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রাম কিংবা শহর সবখাতেই লোডশেডিং চলছে ঘন্টার পর ঘন্টা। সরকার লোডশেডিং এর যে তথ্য প্রকাশ করছে তা ‘ভুয়া’ বলে দাবি সাধারণ মানুষের। শহরের চেয়ে গ্রামে লোডশেডিং এর মাত্রা কয়েকগুণ বেশি।
ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের কারণেই এই ভর্তুকি। অথচ এখনো স্বাভাবিক বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না ভোক্তারা। গ্রাম পর্যায়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। রাজধানী ঢাকার আশপাশেও প্রতিদিন কয়েক দফায় বিদ্যুৎ চলে যায়। আর শিল্প মালিকদের অভিযোগ পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পাওয়ায় মিল-কারখানায় উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, এতে বিনিয়োগে বিদেশিরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা বলেছেন, বিদ্যুত খাতে অরাজকতা বন্ধ না করে দাম বাড়ানো হবে সরকারের জন্য আত্মঘাতী। কারণ বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যে এর প্রভাব পড়বে।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) তাদের ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মূলত বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উৎপাদন না করলেও ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়। গত এক দশকে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ায়। এ কারণেই এতো লোকসান।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশের সাড়ে তিন কোটি ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করে না। বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার, সেবার মান, জ্বালানি পরিচালনা, আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণে পিডিবি ব্যর্থ। জ্বালানির ওপর আরোপিত করভার ভোক্তাসহ দেশের উৎপাদনশীল কাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা বিধ্বংসী ও আত্মঘাতী। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই বিবেচনাযোগ্য নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
এদিকে অবৈধ শেখ হাসিনার সরকার আর থাকছে না- এমন চুড়ান্ত খবর পেয়ে ব্যবসা গোটাচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতের রাঘব বোয়াল কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রপ। এই গ্রপের ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেপিসিএল বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেড় কোটি ডলারে বিক্রি করতে যাচ্ছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১২৯ কোটি টাকা। আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি দেখালেও বাস্তবে এটি কিনতে যাচ্ছে ডরিন গ্রপের কর্ণধার ঝিনাইদহ-২ আসনের নৈশভোটের এমপি তাহজিব আলম সিদ্দিকী।
চাহিদা বিবেচনা না করে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে বহুবিধ অন্যায় সুবিধা ও দায়মুক্তি দিয়ে বেসরকারি খাতে বেশ কিছু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছিল অবৈধ হাসিনা সরকার। এর মধ্যে সামিট গ্রপকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেয়ার অভিযোগ আছে।
সাধারণত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কিছুটা বেশি দামের নিশ্চয়তা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতাকে শর্ত হিসেবে রেখে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু সামিটসহ অন্য বেসরকারি আইপিপিগুলোকে তৃতীয় পক্ষহীন চুক্তিতে তিন থেকে পাঁচ গুণ দামের নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। আছে ক্যাপাসিটি চার্জ, ওভারহোলিং চার্জ, তেল আমদানি প্রণোদনা, কর অবকাশ সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ বহু সভ্রেন গ্যারান্টি। আছে সহজ শর্তের ঋণের সুবিধাও। দলীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে রাষ্ট্রের তহবিল লুটের এমন বেসরকারিকরণ নজিরবিহীন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন