গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবহার করে ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অনুমোদন পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শিগগিরই কেন্দ্রটির সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হওয়ারও কথা। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট একটি ভুয়া কোম্পানি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসায় বিপাকে পড়েছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবি। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ রকম একটি অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
বর্তমানে দেশে বর্জ্য থেকে একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ কেন্দ্রটি ৩৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার। এর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়বে ২৩ সেন্ট। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহপত্র চেয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ১৭টি কোম্পানি আগ্রহপত্র জমা দেয়। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে একটি তালিকা পাঠানো হয় পিডিবির কাছে। এরপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ ওই তালিকা থেকে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে (সিএমইসি) মনোনীত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানোর পর প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চারটি কোম্পানির নাম পাঠানো হয় বিদ্যুৎ বিভাগে। অবশ্য ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট নামে কোম্পানিটিকে কাজ দিতে বিশেষ সুপারিশ করা হয়েছে বলে পিডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ কেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ পড়বে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। তবে কেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি কত হবে সেটি এখনো ঠিক হয়নি। কেন্দ্রটি নির্মাণ হলে এখান থেকে ২৫ বছর ধরে বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। কেন্দ্রটির মালিকানা ও পরিচালনায় থাকবে ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গত ১২ জানুয়ারি সম্মতিপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট) ইস্যু করা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র পেতে ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট অভিজ্ঞতা হিসেবে দাখিল করে চীনা প্রতিষ্ঠান ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন গ্রুপ কোম্পানির। এতে বলা হয়, ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন গ্রুপ কোম্পানির একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হলো ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট। কিন্তু গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানি পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানায়, তারা বাংলাদেশে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য আবেদন করেনি। তারা জানতে পেরেছে যে তাদের কোম্পানির কাগজপত্র ব্যবহার করে একটি ভুয়া কোম্পানি বাংলাদেশে বর্জ্য থেকে ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির অনুমতি পেয়েছে।
চিঠিতে তারা আরও জানায়, কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন জেকিং ২০১৮ সালে ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টাল থেকে বেরিয়ে একটি ভুয়া কোম্পানি তৈরি করেন। সেই কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের নাম ব্যবহার করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি পেয়ে গেছে। ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নয় ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়, তা না হলে তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবে বলেও ওই চিঠিতে জানানো হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, একটি কোম্পানি সব তথ্য জাল করে ৪ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়ে গেলে আগামীতে বড় জটিলতা তৈরি হতে পারে। সে কারণে গত ২৮ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে চীনা দূতাবাস থেকে প্রকৃত কোম্পানির বিষয়ে তথ্য জোগাড় করতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৮ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনা দূতাবাসকে অনুরোধ করেছে ক্যানভেস্ট এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানির অভিযোগের কোনো সত্যতা আছে কিনা। একই সঙ্গে তারা জানতে চেয়েছে ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট কোম্পানির মূল ব্যবসা কী, তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আছে কিনা।
পিডিবির দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চারটি কোম্পানির নাম এসেছিল। তবে ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ ছিল। এ অবস্থায় অনুমতি পাওয়া ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্ট সম্পর্কে ভুয়া কোম্পানির অভিযোগ আসায় তদন্ত শুরু হয়।
জ্বালানিতে এই অভিযোগ পুরনো
বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পিজেএসসি গ্যাজপ্রমকে গ্যাস কূপ খননের কাজ দিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার কোটির বেশি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা গ্যাজপ্রম নয়। এটি নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি, যার মালিকানায় কয়েকজন বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীও রয়েছেন। তবে এই অভিযোগটি জ্বালানি বিভাগ এখন পর্যন্ত আমলে নেয়নি।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৯০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সাতটি কম্প্রেসর স্থাপনের কাজ পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের টেকনো স্ট্রিম এনার্জি। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করেছে সেটা সঠিক নয়। একটি ভুয়া কোম্পানিকে এত বড় কাজ দেওয়া হয়েছিল, পরে যা বাতিল করা হয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতে এ রকম একটি অভিযোগ গ্যাজপ্রমকে নিয়ে রয়েছে যে তারা নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত এবং ব্যক্তিপর্যায়ের কোম্পানি; রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি নয়। এখন বিদ্যুৎ বিভাগকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, তারা ভুয়া কোম্পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ পেয়েছে এমন অভিযোগের তদন্ত করছে। আমি আশা করব জ্বালানি বিভাগও বিদ্যুৎ বিভাগের দেখাদেখি এ রকম তদন্ত করবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন