সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক নির্দেশনা কর্মশালার আয়োজকদের সঙ্গে বিতর্কিত সেই মুরাদ খানের পূর্বপরিচয় রয়েছে। এর আগে দেশে-বিদেশে নাটক বিষয়ক নানা অনুষ্ঠানে লেখক-নির্দেশক মুরাদ খানের সঙ্গে তারাও অংশ নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে থাকা নানা ভিডিও এবং ছবির পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে এমইনটা দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় নাট্য সংগঠনের নেতারা বলছেন, কোনো ধরনের দুরভিসন্ধি থেকে আয়োজকরা মুরাদ খানকে এখন চেনেন না বলে দাবি করছেন। প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার বিতর্কিত প্রতিবেদনের নেপথ্যে যুক্ত মুরাদ খানকে অপরিচিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের দেওয়া বিবৃতিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন ‘মিথ্যাচার’।
গত ২২ মে শিল্পকলা একাডেমিতে তিনদিনব্যাপী নির্দেশনা কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে মুরাদ খান উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সহযোগিতায় কর্মশালার আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মশালায় দেশবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির ‘অতিথি’ হওয়া নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, আল-জাজিরার বিতর্কিত প্রতিবেদনে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মুরাদ খান নামের এক ব্যক্তি। সিলেটে শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মশালার অনুষ্ঠানে মঞ্চে আসন নেওয়া যে ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক তার নামও মুরাদ খান। কর্মশালায় উপস্থিত মুরাদ খানের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী। তার ওই স্ট্যাটাসের পর ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
গত ২৪ মে সমকাল অনলাইনে এক ‘মুরাদ খান’কে নিয়ে তোলপাড় সিলেটে শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরদিন ২৫ মে সমকাল পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘আল-জাজিরার ডকুমেন্টারি: সিলেটে শিল্পকলার অনুষ্ঠানে সেই মুরাদ খান’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এই সংবাদের পর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে মুরাদ খানকে ‘জনৈক’ উল্লেখ করে তার সঙ্গে ফেডারেশন বা শিল্পকলা একাডেমির পূর্বপরিচয় নেই বলে দাবি করে।
তবে সিলেটে নাট্য সংগঠনের নেতারা বলেছেন, আল-জাজিরার বিতর্কিত প্রতিবেদনে কণ্ঠ দেওয়ার আগে দেশে একাধিক নাট্য সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মুরাদ খান। তার লেখা নাটক ‘কন্যা’ ঢাকার প্রাচ্যনাটের অন্যতম প্রযোজনা; যা সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, মুরাদ খান সিলেট ও ঢাকায় একাধিক নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বার্মিংহামে নাট্য চর্চার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে, শিল্পকলা একাডেমিতে নাট্য নির্দেশনা কর্মশালার আয়োজকরা নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ফলে মুরাদ খানকে না চেনার দাবি করা দুঃখজনক।
তিনি বলেন, আমরা মুরাদ খানকে চিনি। রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবেদনে তার কণ্ঠ দেওয়া নিন্দনীয়। এজন্য তার বিচার দাবি করি। কিন্তু নাটকের মানুষ হয়ে তাকে চিনি না, এমন বলার সুযোগ নেই। কর্মশালার আয়োজকরা তাকে ‘জনৈক’ বা ‘আগন্তুক’ বলে দাবি করলেও বাস্তবে তার সুযোগ নেই। সেদিনের অনুষ্ঠানে তাকে কেউ না কেউ আমন্ত্রণ করেছেন।
সেদিনের কর্মশালার প্রশিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে মুরাদ খানের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে; যার প্রমাণ ফেসবুকেও পাওয়া যায় বলে জানান রজত কান্তি গুপ্ত। তিনি বলেন, অতীতে শত শত নাট্যকর্মীর উপস্থিতিতে সিলেটে সম্মিলিত নাট্য পরিষদের অনুষ্ঠানে তারা অংশ নিয়েছেন। আর সেদিনের কর্মশালার মঞ্চে শুধু নয়, অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ফটোসেশনেও মুরাদ খানকে আয়োজকদের সঙ্গে দেখা গেছে। তিনি আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী ‘আগন্তুক’ হলে নিশ্চয় এই সম্মান দেওয়া হতো না।
তিনি আরও বলেন, মুরাদ খানকে আমন্ত্রণ করার ভুলটা হয়ত না বুঝেই করেছেন আয়োজকরা। তবে পুরো বিষয় জানার পর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারতেন। তা না করে মুরাদ খানকে চেনেন না বলে দাবি করার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু পুরো ঘটনার পেছনে ‘দুরভিসন্ধি’ রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মুরাদ খান আমাদের সমসাময়িক নাট্যকর্মী। তিনি প্রবাসে যাওয়ার আগে আমরা একসঙ্গে নাটক করেছি। নাট্যকর্মী হিসেবে মুরাদের কাজে আমরা গর্বিত ছিলাম। তিনি সিলেটে ও ঢাকায় নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রবাসেও তিনি তা অব্যাহত রেখেছেন।
তিনি বলেন, আল-জাজিরার বিতর্কিত প্রতিবেদনে কণ্ঠদাতা হিসেবে মুরাদসহ যে তিনজনের নাম জানা গেছে তাদের কেউ এখন পর্যন্ত তা অস্বীকার করেননি। মুরাদ খান ক্ষমা চেয়েছেন বলেও শুনিনি। এ অবস্থায় সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মশালায় তাকে অতিথি করে আনা নিন্দনীয়।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অনিরুদ্ধ ধর শান্তনু, প্রধান প্রশিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী দীর্ঘদিন ধরে নাটকের সঙ্গে আছেন বলে জানান মিশফাক আহমদ মিশু। তিনি বলেন, অতীতে সশরীরে এই দু’জনের পাশাপাশি মুরাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমিও অংশ নিয়েছি। ফলে মুরাদকে চিনি না বলার সুযোগ নেই। করোনাকালে মঞ্চনাটক নিয়ে ভাবনা ও করনীয় নিয়ে অনলাইন অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে শান্তনু ও মুরাদ দু’জনেই ছিলেন; যার ছবি ফেসবুকে আছে। এখন যারা মুরাদকে চেনেন না বলে দাবি করছেন, তাদের নিশ্চিতভাবে কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। এছাড়া অনুষ্ঠানের সভাপতির অনুমতি ছাড়া কাউকে অতিথি করার বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক বলে মন্তব্য করেন রজত কান্তি গুপ্ত।
এদিকে সিলেটে নাট্য নির্দেশনা কর্মশালার উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের অতিথিদের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দাওয়াত দিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন জেলা কালচারাল অফিসার অসিত বরণ দাস গুপ্ত। অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ধর শান্তনু দাবি করেছিলেন, তিনিও মুরাদ খানকে চেনেন না। ফেসবুকে কর্মশালার ব্যাপক প্রচারণা দেখে মুরাদ খান সমাপনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্যাডে দেওয়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘মুরাদ খান তার পরিচয় দেওয়ার পর তাকে দর্শক হিসেবেই মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।’ এছাড়া মঞ্চে চেয়ারে বসা প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উপস্থাপকের চেয়ারটি খালি ছিল বিধায় সে (মুরাদ খান) বক্তব্য রাখার পর খালি চেয়ারে বসে।’
এরপর আজ শুক্রবার প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী একাধিক ছবিসহ ‘প্রসঙ্গ: মুরাদ খান ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মিথ্যাচার কিছু কথা’ শিরোনামে ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন। দীর্ঘ স্ট্যাটাসের মধ্যে তিনি লিখেন, ‘বিবৃতিতে মুরাদ খানকে অস্বীকার করা হলেও বক্তব্যে মুরাদ খানের উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের আয়োজক যারা ছিলেন তারা দীর্ঘদিন ধরে নাট্য আন্দোলনের সাথে জড়িত। জেলা কালচারাল অফিসার অসিত বরণ দাস গুপ্তও একজন নাট্যকর্মী/সংস্কৃতিকর্মী। নাট্য নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী, অনিরুদ্ধ কুমার ধর, জালাল উদ্দিন রুমিও দীর্ঘদিন ধরে নাটক নিয়েই কাজ করছেন।’
এসব কারণে আয়োজনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা মুরাদ খানকে না চেনার কোনো অবকাশ নেই উল্লেখ করে প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মতো একটি অভিভাবক সংগঠনের প্যাড ব্যবহার করে এরকম মিথ্যাচার কার্যত ফেডারেশনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করল।
এদিকে বিতর্কিত মুরাদ খানের সিলেটে আসা বা শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মুরাদ খানের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তিনি মায়ের অসুস্থতার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসেছেন। এমনকি নাট্য নির্দেশনা কর্মশালার সমাপনী দিনের আগের রাতে আয়োজকদের সঙ্গে নগরীর জিন্দাবাজারের একটি রেস্টুরেন্টেও তাকে দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার তার যুক্তরাজ্যে ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। তবে তিনি ফিরেছেন কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে আল-জাজিরার ওই প্রতিবেদন গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সম্প্রচার হলে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি ভিত্তিহীন দাবি করে কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ জানায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন