চট্টগ্রামের আলোচিত শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন হত্যা মামলার বিচার ১৯ বছরেও শেষ হয়নি। ক্ষোভ-হতাশা আর আতঙ্কে বাড়িঘর তালা দিয়ে এলাকা ছেড়ে অনেকটা আত্মগোপনে আছে তার পরিবার। বিচার কাজে তারা আদালতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
বিচারক তাদের খুঁজে আদালতে হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ফলে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। আর সরবে বীরদর্পে ঘুরছে ঘাতক চক্র।
এদিকে, দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হেলাল উদ্দিন সম্প্রতি আনোয়ারা থানা বিএনপির কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। এ ঘটনার সূত্র ধরেই এক আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কপি এসেছে যুগান্তরের হাতে। জবানবন্দিতে অপহরণের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে ছিল হেলালের নাম।
প্রায় ১৭ বছর আগের ওই জবানবন্দি থেকেই জানা গেছে ১৯ বছর আগে সংঘটিত লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর নানা অজানা তথ্য। রহস্যজনক কারণে তদন্ত সংস্থাও কোনোদিন জবানবন্দির তথ্য প্রকাশ করেনি।
মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই রাতে চট্টগ্রামের চকবাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চান্দগাঁওয়ের বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন। তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে অপহরণের দুই বছর পর অপহরণকারী চক্রের সদস্য আনোয়ারা সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম গ্রেফতার হয়। একই সময়ে গ্রেফতার হয় চট্টগ্রামের এক সময়ের দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার মাহবুব ওরফে কালা মাহবুব।
তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতেই ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধার করে র্যাব। সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষার পর কঙ্কালটি জামাল উদ্দিনের বলে নিশ্চিত হয় পরিবার। এরপর অপহরণ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করে শুরু হয় তদন্ত।
মামলার অন্যতম আসামি আনোয়ারা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জামাল উদ্দিনকে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়।
জানতে চাইলে নিহত জামাল উদ্দিনের ছেলে ও মামলার বাদী ফরমান রেজা লিটন বলেন, ‘আমি কয়েকবার অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেই। এরপরও তদন্ত সংস্থা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়। যাদের নাম শহিদ চেয়ারম্যানের জবানবন্দিতে ছিল।
এমনকি এজাহারে যাদের আসামি করেছিলাম তাদের কয়েকজনকেও অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমরা ন্যায়বিচার পাব না এটা বুঝে গেছি। তাই এ নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। সবই তো বোঝেন।’
জবানবন্দিতে অজানা তথ্য: মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম (শহিদ চেয়ারম্যান) জবানবন্দিতে বলে, ঘটনার দিন একটি অটোরিকশায় বহদ্দারহাট মসজিদের সামনে গিয়ে দেখি নাজিম, অমর দাস, গ্যারেজ কাসেম (বাড়ি চন্দনাইশ), হেলাল, ইসহাক ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। অমর দাসের বাড়ি হালিশহর।
হেলালের বাড়ি হাইলধর ও নাজিমের বাড়ি কুনিরবিল। শহীদ চেয়ারম্যানকে দেখেই তারা হেসে হেসে বলে জামাল উদ্দিনকে অপহরণ করা হবে। বিষয়টি শুনে শহিদ হাস্যকর মনে করেন। এ অবস্থায় তারা শহিদকে গাড়িতে উঠতে বলে এবং তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তোলে। তার সঙ্গে ওঠে ইসহাক। গাড়িতে উঠে সে শফি (বাড়ি রাউজান), বাবু (চকবাজারের বেকারি ব্যবসায়ী) ও ড্রাইভার সোবহানকে দেখতে পায়। গাড়িতে আরও দুজন ছিল যাদের সে চেনে না।
মসজিদের সামনে অমর, হেলাল, গ্যারেজ কাসেম দাঁড়িয়ে থাকে। তারা পেছনের আরেকটি গাড়িতে আসবে বলে জানায়। শহিদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসহাক গাড়িটি চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার দিতে চালাতে থাকে। আবাসিক এলাকার ভেতর প্রবেশের সময় মোবাইলে ড্রাইভার ইসহাক ও নাজিম, অমর ও হেলালের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর মাইক্রোবাসটি দিয়ে একটি রিকশার গতিরোধ করা হয়। নাজিম, শফি, বাবু, সোবহান ও শহিদ নেমে রিকশায় বসা ব্যক্তিকে ধরে মাইক্রোবাসে তোলে। এরপর শহিদ ওই গাড়িতে না গিয়ে কিছুদূর হেঁটে সামনে যাওয়ার পর রিকশায় বহদ্দারহাট মোড়ে যায়।
সেখানে গিয়ে অমর দাস, হেলাল, গ্যারেজ কাসেমকে দাঁড়ানো দেখতে পায়। তারা হেসে হেসে শহিদকে বলে, গাড়িতে যাকে (মাইক্রোবাসে) ওঠানো হয়েছে তিনিই জামাল উদ্দিন। তখন হেলাল ও গ্যারেজ কাসেম আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বলে পরে কথা হবে।
জবানবন্দির শেষাংশে শহিদ বলে, ‘জামাল উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। ওইখান থেকে আমি চলে যাই। তখন রাত ৮টা-৯টার মতো হবে। তারপর থেকে আমি আত্মগোপন করি। অনুমান ৮-১০ দিন পর নাজিম, হেলাল ও অমর আমার মোবাইল ফোনে বলে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথাবার্তা হয়েছে। তারা বলে বহদ্দারহাট কবরস্থানে টাকাগুলো দেবে মুক্তিপণ হিসাবে। তারপর থেকে আমি তাদের ফোন করে একটু পরে কথা বলব বলে কেটে দেই। ১ মাস ১৯ দিন পর, দিনে একজন আমার ফোনে পরিচয় দিয়ে বলে যে আমি কাশেম চৌধুরীর বড় ভাই হাসান চৌধুরী। আপনি কি শহিদ চেয়ারম্যান?
উত্তরে আমি বলি হ্যাঁ। তখন সে জানায়, কাসেম চৌধুরী, হেলাল, নাজিম, অমর, ইসহাক, শফিককে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য কাশেম চৌধুরীর কথাটা আপনি তাদের ফোন করে জানিয়ে দেন যে, জামাল উদ্দিনকে মেরে ফেলার জন্য কাশেম চৌধুরী তার লোকজনকে হুকুম দিয়ে দিছে। ওইটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমি কাউকে বলতে পারিনি। আমি আত্মগোপন করে থাকি। কাশেম চৌধুরী ফটিকছড়ির চেয়ারম্যান। কাশেম চৌধুরীর বাড়িতে আমি ঘটনার আগে তিন-চারবার গিয়েছি। দাওয়াত দিয়েছিল। নাজিম, হেলালের মাধ্যমে উনার সঙ্গে পরিচয়।
হেলালের আনোয়ারার এমপির ভাই মারুফ নিজামের সঙ্গে ব্যবসা আছে। হেলাল, নাজিম, ইসহাক খুবই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। আমি মুক্তিপণের কোনো টাকাই পাইনি। অপহরণের পর জামাল উদ্দিনের পরিবার অর্থাৎ জামাল উদ্দিনের স্ত্রী, শ্যালক, ভাই, সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আমার সঙ্গে কয়েকবার মুক্তিপণের টাকা কাকে দিলে, কিংবা কাকে ধরলে জামাল উদ্দিনকে পাওয়া যাবে এই বিষয়ে জানতে চাইলে আমি বলি-হেলাল, নাজিম, অমর ও ইসহাককে ধরলে জামাল উদ্দিনকে পাওয়া যাবে। আরও বলি, আমি নিজেও খবর পেলে আপনাদের জানাব। ২ মাসের মাথায় আমার মোবাইল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি-এই আমার জবানবন্দি।’
তদন্ত ও বিচার : অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুরু থেকেই এ মামলার তদন্ত প্রভাবশালীদের প্রভাবে ঘুরপাক খেয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম তদন্ত শেষ করে থানা পুলিশ এজাহারভুক্ত অনেক আসামিকে বাদ দিয়ে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করে আদালতে নারাজি দেন বাদী। আদালতের নির্দেশে মামলার পুনঃতদন্তের দায়িত্ব পায় চট্টগ্রাম সিআইডি।
২০০৯ সালে সিআইডি ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে মামলার এক নম্বর আসামি শিবির ক্যাডার কালা মাহবুবকে রাজ সাক্ষী করা হয়। মাহবুব ও শহিদ চেয়ারম্যানের জবানবন্দিতে যাদের নাম আসে তাদের কয়েকজনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এসব কারণে ফের অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেন বাদী। এ দফায়ও নারাজি আবেদন আমলে নিয়ে আদালত সিআইডি চট্টগ্রামের আরেক কর্মকর্তাকে পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেন। ২০১১ সালে তিনিও প্রায় অভিন্ন অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে বিচার শুরু হয়।
এ অবস্থায় মামলার এক নম্বর আসামিকে রাজসাক্ষী করায় মামলার আরেক আসামি সোবহান ড্রাইভার হাইকোর্টে রিট করলে বিচারে স্থগিতাদেশ দেন। বিচার কাজ বন্ধ থাকে ৩ বছর। ১১ সালে রিট নিষ্পত্তি করে বিচারকাজ চালানোর আদেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের আদেশ চট্টগ্রাম বিচার আদলতে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ বছর। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম জজ আদালতে ফের বিচার শুরু হয়।
চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির জন্য ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর ৭ বছর পর ২০১৭ সালে মামলাটি দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু বারবার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন পেছানোর কারণে হতাশায় পড়েন বাদী। ৩৯ বার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন পেছানোর ফলে বিচার না পাওয়ার হতাশা নিয়ে আদালতে যাওয়া ছেড়ে দেন তিনি। এ অবস্থায় বাদীকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন বিচারক। কিন্তু সেই নির্দেশনা কার্যকর না হওয়ায় বিচার থমকে আছে।
আরও জানা গেছে, মামলার রাজসাক্ষী কালা মাহবুব ২০১৬ সালে কারাগারেই মারা যায়। আসামি সুলতান ড্রাইভার পাগল হয়ে যাওয়ায় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আরেক আসামি কাঞ্চননগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ২০১১ সাল থেকে নিরুদ্দেশ। তার অবস্থান সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে গুঞ্জন আছে সে ‘গুম’ হয়েছে। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা থেকে অব্যাহতি পায় নাজিম উদ্দিন (নাজিম চেয়ারম্যান) নামের আরেক আসামি। ২০১৯ সালে জামিনে কারামুক্ত হয় আরেক আসামি মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম (শহিদ চেয়ারম্যান)।
জামাল উদ্দিনের ছেলে জানান, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের একজন হেলাল উদ্দিন ওরফে কালা হেলাল। মামলার এজাহারে তার নাম ছিল। হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন সে বিদেশে পালিয়ে ছিল। দেশে আসার পর র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছিল। ২০ এপ্রিল তাকে আনোয়ারা বিএনপির সদস্য সচিব করায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন হত্যা মামলার মাস্টারমাইন্ডকে বিএনপির কমিটিতে স্থান দেওয়ার বিরোধিতা করে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে হেলাল উদ্দিন বলে, ‘এটা অনেক আগের ঘটনা। এর সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। এই মামলার এজাহার বা অভিযোগপত্র কোথাও আমার নাম নেই। শহিদ চেয়ারম্যান জবানবন্দিতে কি বলেছে তা আমার জানা নেই। যারা তদন্ত করেছেন তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ সম্পর্কেও আমি কিছু জানি না।
দীর্ঘদিনেও আলোচিত এ মামলার বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আইয়ুব খান বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় আলোচিত এই হত্যা মামলার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেও লাভ হয়নি। মামলার বাদী আদালতে হাজির না হওয়ায় বিচার কাজে অগ্রগতি নেই। আদালতের নির্দেশে বাদীকে খুঁজে বের করার চেষ্টাও সফল হয়নি। মামলার বাদী ফরমান রেজা লিটনকে খুঁজে পাওয়া না গেলে কিংবা তিনি নিজ উদ্যোগে বিচার কাজে আদালতে হাজির না হলে অগ্রগতি সম্ভব নয়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন